জলবায়ু ঝুঁকি ও ক্রপ ইন্সুরেন্স

সমীরণ বিশ্বাস:জলবায়ু পরিবর্তন ধকল ও ফসল নিরাপত্তায়: কৃষকের পাশে ক্রপ ইন্সুরেন্স। জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের ধরণ, আর্দ্রতা, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং খরার সময়কালকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা যায়, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধি গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে ত্বরান্বিত করছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামা, অসময়ে বৃষ্টি, দীর্ঘ খরা, আকস্মিক বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কীট-পোকার জীবনচক্রের পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশের ফসল উৎপাদনকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশের কৃষিখাতে প্রায় ৭০% কৃষক জলবায়ুজনিত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করেন। ধান, গম, ভুট্টা, শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলচাষ, সব ক্ষেত্রেই আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা উৎপাদনশীলতা কমাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অতিবৃষ্টিতে জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, ফলে ধানের শিকড়ে অক্সিজেন প্রবাহ কমে গিয়ে Yield Decline ঘটে। আবার উচ্চ তাপমাত্রায় পরাগায়ন ব্যাহত হওয়ায় ধান ও গমের শীষে দানা পূর্ণতা পায় না, যাকে বিজ্ঞানীরা Heat Stress বলে থাকেন। খরার সময় মাটির আর্দ্রতা কমে গিয়ে সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয় এবং ফসল শুকিয়ে যায়। এই অনিশ্চয়তার মাঝে কৃষকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্রপ ইন্সুরেন্স একটি কার্যকর বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক সমাধান। ফলে কৃষকের ফসল নষ্ট হওয়ার আগেই বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকি নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান সম্ভব হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন যখন কৃষিকে ক্রমশ অস্থিতিশীল করে তুলছে, তখন ক্রপ ইন্সুরেন্স কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়ায়। এটি কৃষিকে শুধু নিরাপদ করে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই উৎপাদন এবং জলবায়ু-সহনশীল কৃষি গড়ে তুলতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে যে হারে প্রভাবিত করছে, তা কৃষি বিজ্ঞানীদের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী গত কয়েক দশকে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে চরম আবহাওয়ার ঘটনা, অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, দীর্ঘস্থায়ী খরা, লবণাক্ততার বিস্তার, ঘূর্ণিঝড়ের ঘনত্ব ও তীব্রতা। Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি অঞ্চলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে বাংলাদেশ যেখানে কৃষি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান স্তম্ভ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও ফসলের প্রভাব:

জলবায়ু পরিবর্তন ফসলের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভিদের স্টোমাটাল কন্ডাকট্যান্স কমে যায়, ফলে আলোকসংশ্লেষণ হ্রাস পায়। একই সঙ্গে খরা বা মাটির আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে শেকড়ের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং পুষ্টি গ্রহণ ব্যাহত হয়। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি বা জলাবদ্ধতা শেকড়ে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করে, ফলে শিকড় পচন এবং ফলন হ্রাসের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ আর্দ্রতা ছত্রাকজনিত রোগ-বালাই দ্রুত ছড়াতে সহায়তা করে। এসব বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন মাঠপর্যায়ে উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি ডেকে আনে।

ক্রপ ইন্সুরেন্স ও চ্যালেঞ্জ:

বাংলাদেশে কৃষকের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো; এই বৈজ্ঞানিক ক্ষতিগুলো আর্থিক ধাক্কায় রূপ নেয়। জাতীয় পরিসংখ্যান বলছে, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির কারণে অনেক কৃষকের মৌসুমী বিনিয়োগের ৫০–১০০% পর্যন্ত ক্ষতি হয়। স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, জলবায়ু-সহনশীল জাত কিছুটা সুরক্ষা দিলেও কৃষকের আর্থিক টিকে থাকার জন্য পর্যাপ্ত নয়। সেই কারণে বৈজ্ঞানিকভাবে সুরক্ষিত ক্রপ ইন্সুরেন্স বা ফসল বীমা আজ কৃষির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হিসেবে বিবেচিত।

ক্রপ ইন্সুরেন্স ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ:

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রপ ইন্সুরেন্স হলো কৃষি ঝুঁকির পরিমাপ ও ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নভিত্তিক একটি পরিসংখ্যানসমৃদ্ধ মডেল। এখানে ফসলের ক্ষতি নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ডেটা, IoT (Internet of Things) ভিত্তিক মাটি আর্দ্রতা সেন্সর, NDVI (Normalized Difference Vegetation Index), Yield Forecast Model এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম। এসব প্রযুক্তি ফসলের বৃদ্ধি, স্ট্রেস লেভেল, আর্দ্রতা ও উৎপাদন সম্ভাবনা নির্ণয়ে উচ্চ নির্ভুলতা প্রদান করে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্বচ্ছ, দ্রুত ও বৈজ্ঞানিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়।

ইনডেক্স–বেইজড ক্রপ ইন্সুরেন্স:

ক্রপ ইন্সুরেন্স মূলত আবহাওয়াজনিত ঝুঁকিকে পরিমাপযোগ্য সূচকে (যেমন: Rainfall Index, Temperature Index, Flood Index) রূপান্তর করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে, যা Weather-Index Based Crop Insurance নামে পরিচিত। সেন্সর-নির্ভর আধুনিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, স্যাটেলাইট ডেটা, রিমোট সেন্সিং ও IoT প্রযুক্তি এখন এই বিমা ব্যবস্থাকে আরও নির্ভুল করে তুলছে।

বিশ্বজুড়ে এখন দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে ইনডেক্স–বেইজড ক্রপ ইন্সুরেন্স, যেখানে ক্ষতিপূরণ নির্ভর করে নির্দিষ্ট সূচকের ওপর, যেমন: বৃষ্টিপাত নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নামলে বা তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার ওপরে উঠলে, অতিবৃষ্টি, দীর্ঘস্থায়ী খরা, লবণাক্ততার বিস্তার এবং অতি কুয়াশায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বীমার অর্থ প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতি ক্ষতির যাচাইয়ের জটিলতা কমিয়ে কৃষকের হাতে দ্রুত আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশেও পরীক্ষামূলকভাবে এই আধুনিক মডেল ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় পরিসরে কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

ক্রপ ইন্সুরেন্স ও টেকসই কৃষি:

জলবায়ু পরিবর্তনের অনিশ্চয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফসল বীমা কেবল ক্ষতির ক্ষতিপূরণ নয়, বরং কৃষকের পুনঃবিনিয়োগ সক্ষমতা, ঋণ গ্রহণযোগ্যতা, এবং গ্রামীন অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একই সঙ্গে এটি কৃষকদের জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করে, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৃষি উন্নয়নের পথ সুগম করে।

সুতরাং বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল মোকাবিলায় কৃষকের পাশে নির্ভরযোগ্য আর্থিক নিরাপত্তা গড়ে তুলতে ক্রপ ইন্সুরেন্সই ভবিষ্যৎ কৃষি ব্যবস্থার অন্যতম শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সহায়ক। এটি শুধু কৃষকের ফসল নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি অর্থনীতি এবং সামগ্রিক উন্নয়ন সুরক্ষার একটি প্রমাণভিত্তিক সমাধান।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।