এগ্রিলাইফ প্রতিবেদক:: বর্তমানে দেশে ডিমের বাজারে নায্য মূল্যের অভাবের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি লেয়ার খামারিরা মারাত্মক সংকটের মুখে পড়েছেন। উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারে ডিমের দাম কমে যাওয়ায় খামারিরা প্রতিনিয়ত লোকসানের শিকার হচ্ছেন। পোল্ট্রি শিল্পের এই সংকট সমাধানে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন (বিপিআইএ)। অন্যথায়, দেশের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে এই খাতের অবদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) মিরপুর ডিওএইচএস-এ বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি শাহ হাবিবুল হকের সভাপতিত্বে মহাসচিব খন্দকার মহসিন লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা উল্লেখ করেন, প্রতি বছর পবিত্র মাহে রমজান মাসে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে এবং বেকারি, বিস্কুট ফ্যাক্টরির উৎপাদন কমে যাওয়ায় ডিমের চাহিদা কমে যায়। এবার সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে, যার ফলে ফার্মগেট পর্যায়ে ডিমের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১১.৬৪ টাকা হলেও বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৯.১০-৮.৬০ টাকায়, ফলে প্রতি ডিমে খামারিদের ২.৫৪ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের টিকিয়ে রাখতে বিপিআইএ আট দফা দাবি উত্থাপন করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো:
১. ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জরুরি ভিত্তিতে নগদ আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
২. বিদ্যুৎ বিলে ২০% রিবেট প্রদান এবং তা সহজ শর্তে অনুমোদন করা।
৩. স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা।
৪. কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুসারে উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ডিমের মূল্য পুনঃনির্ধারণ।
৫. প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৬. ডিম ও মুরগির বাজার ব্যবস্থায় দক্ষ সরবরাহ চেইন গড়ে তোলা এবং ফড়িয়া সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমানো।
৭. ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান।
৮. "জাতীয় পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড" গঠন করে পোল্ট্রি শিল্পের সমস্যা সমাধান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন জেলার খামারিরা তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। গাজিপুরের খামারি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, "সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করলে সরকার যদি ভর্তুকি না দেয়, তাহলে অনেক খামারি এই সংকটে হারিয়ে যাবে।"
নরসিংদীর খামারি বিলকিস বেগম বলেন, "আমি গত ১০ বছর ধরে খামার করছি এবং পুরোপুরি খামারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন ৮.৬০ টাকায় ডিম বিক্রি করছি, যা আমাদের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। আমাদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার।"
বিপিআইএ-এর সিনিয়র সহ সভাপতি খন্দকার মনির আহম্মেদ বলেন, "গত বছরের ৬ই নভেম্বর ভোক্তা অধিদপ্তর আয়োজিত সভায় আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, মনিটরিং সেল গঠন করে আপদকালীন সময়ে ক্ষুদ্র খামারিদের ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। যদি এটি কার্যকর করা হতো, তাহলে আজ খামারিরা এই সংকটে পড়তেন না।"
পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার বলেন, "রমজানের পর যদি খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন, তাহলে সামনে ডিমের তীব্র সংকট তৈরি হবে এবং বাজারে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। এতে ভোক্তা ও খামারিরা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।"
বিপিআইএ-এর জয়েন্ট সেক্রেটারি, নূরুল মোর্শেদ খান বলেন, বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা এই শিল্পের মেরুদণ্ড। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দেশের ডিম উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় এবং ভোক্তারা স্বাভাবিক দামে ডিম কিনতে পারেন।
সংবাদ সম্মেলনে নরসিংদী, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জের শামীম মৃধা, গাজী নূর, মোঃ সাদেকুর রহমান, মোঃ রফিকুল ইসলাম, মোঃ শহীদ মল্লিক, মোঃ সোলেমান কবির প্রমুখ খামারিরা সংবাদ সম্মেলনে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন।