এসিআই গম ১ ও ২: উচ্চ ফলন ও পুষ্টিগুণে কৃষকের নতুন ভরসা

এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম:বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উন্নত জাতের ব্যবহার অপরিহার্য। গম বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য, তবে কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জাতের সীমিত উৎপাদনশীলতার কারণে প্রত্যাশিত লাভ পাননি। এ পরিস্থিতিতে, দেশে বেসরকারি ক্ষাতে এসিআই নিজস্ব গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত গমের জাত : এসিআই গম ১ ও ২ দেশের গম চাষে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গম উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ফরিদপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় জাত দুটি উচ্চ ফলন ও পুষ্টিগুণে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।

উৎপাদনশীলতায় বৈপ্লবিক সাফল্য
চলতি মৌসুমে সারাদেশে কৃষকের মাঠে ফলন পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে, এসিআই গম ১ ও ২ জাত দুটি বিঘা প্রতি প্রায় ১৮-২০ মন পর্যন্ত ফলন দিয়েছে, যা প্রচলিত জাতগুলোর থেকে ৩-৫ মন পর্যন্ত বেশি। এতে করে একদিকে কৃষকদের যেমন আয় বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি উচ্চ ফলনের কারণে কৃষকরা কম জায়গায় বেশি উৎপাদন করতে পারছেন, যা জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করছে।

সম্প্রতি, ফরিদপুরের জেলার খলিলপুর গ্রামের কৃষক জনাব মো: এরশাদ হোসেন এর মাঠে ফসল কর্তন করে দেখা যায় এসিআই১ জাত ১০৫ দিনে ফলন পেয়েছেন প্রায় ১৮.২ মন। এছাড়াও বাকচর, খলিলপুর গ্রামের কৃষক জনাব ওহাব মোল্লার মাঠে এসিআই গম২ মাত্র ১০৮ দিনে বিঘা প্রতি প্রায় ১৮ মন ফলন দিয়েছে। এছাড়াও মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, নাটোর, নওগাঁ, এবং ঠাকুরগাঁও অঞ্চলেও জাত দুটি বিঘা প্রতি প্রায় ২০ মন পর্যন্ত ফলন দিয়েছে।

উন্নত গুণগত বৈশিষ্ট্য
এসিআই গম ১ ও ২ শুধুমাত্র বেশি উৎপাদনশীল নয়, এটি গুণগত মানের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট। এই জাতগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হল উচ্চ গ্লুটেন ও প্রোটিন মাত্রা, যা গমের গুণগত মান উন্নত করে এবং বেকারি ও খাদ্যশিল্পের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করে তোলে।

গ্লুটেনের পরিমাণ: এসিআই গম ১ এ ৩২.০২% এবং এসিআই গম ২ এ ২৮.৯%, যা স্থানীয় জাতগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। উচ্চ গ্লুটেনের ফলে এই গম থেকে তৈরি ময়দা বেশি স্থিতিস্থাপক হয়, যা রুটি, পাউরুটি, পাস্তা, নুডলস ও অন্যান্য বেকারি পণ্যের মান উন্নত করে।

প্রোটিনের পরিমাণ: প্রায় ১৩.২% ও ১২.৯%, যা খাদ্যমানের দিক থেকে অত্যন্তসমৃদ্ধ এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কৃষকদের জন্য লাভজনক বৈশিষ্ট্য
এসিআই গম ১ ও ২ জাতের মধ্যে বেশ কিছু উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা কৃষকদের জন্য বাড়তি সুবিধা নিয়ে এসেছে: ডিগপাতা চওড়া - যা গমের বৃদ্ধি ও বেশি দানা উৎপাদনে সহায়ক। এসিআই গম ১ একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। জাতটির গাছের উচ্চতা ৯৫-১০০ সেমি, প্রতি গাছে ৬-৭টি স্পাইক, এবং প্রতি স্পাইকে ৫২-৬০টি দানা থাকে। এক হাজার শস্যের ওজন ৬৬ গ্রাম। জাতটির জীবনকাল ১০৫-১১০ দিন এবং হেক্টর প্রতি ফলন ৫.৫-৫.৮ মেট্রিক টন। এসিআই গম ২ একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত জাতটির গাছের উচ্চতা ৯৯-১০০ সেমি, প্রতি গাছে ৫-৬টি স্পাইক, এবং প্রতি স্পাইকে ৫৩-৬২টি দানা থাকে। এক হাজার শস্যের ওজন ৬৪ গ্রাম। জাতটির জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং হেক্টর প্রতি ফলন ৫.৩-৫.৭ মেট্রিক টন। এছাড়াও এইজাতের গাছগুলো মোটা এবং শক্তিশালী, সহজে হেলে পড়ে না। দানা গুলো আপেক্ষকৃত পরিষ্কার উজ্জ্বল ও আকর্ষনীয় হলুদ বর্ণের হওয়ায় বেশি দামে এবং সহজে বিক্রি করা যায়।

অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উপকারিতা
এসিআই গম ১ ও ২ জাতের উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং গুণগত মানের কারণে এটি কৃষকদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠেছে। কম খরচে অধিক উৎপাদন হওয়ায় কৃষকরা বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারছেন। পাশাপাশি, এর উচ্চ গøুটেন ও প্রোটিন মানের কারণে এই গম শিল্পখাতেও ব্যাপক চাহিদা থাকবে।

পরিবেশগত দিক থেকেও এই জাত দুটি বেশ উপযোগী। রোগবালাই সহনশীল হওয়ায় সেচ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম প্রয়োজন হয়, যা মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। পাশাপাশি, এ জাতগুলি শুকনো ও কম আর্দ্রতাযুক্ত পরিবেশেও ভালো ফলন দিতে সক্ষম, যা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬.৪ মিলিয়ন টন গম আমদানি করতে হয়, যার ফলে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা খরচ করতে হয়, এসব উচ্চফলনশীল এবং উচ্চ গ্লুটেন সম্পন্ন জাতগুলো সারাদেশে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াগেলে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

এসিআই গম ১ ও ২ জাত বাংলাদেশের গম উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। উচ্চ ফলন, উন্নত মান ও পুষ্টিগুণের কারণে এই জাত দুটি দ্রত কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এটি শুধুমাত্র কৃষকদের আয় বৃদ্ধিই করবে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্পখাতের কাঁচামাল সরবরাহ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

এ জাতগুলোর ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি আরও লাভজনক এবং টেকসই হবে বলে আশা করা যায়।
প্রয়োজনে: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.