মহিষাসুর দশভুজা দুর্গা

সমীরণ বিশ্বাসঃ দুর্গা, যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন; অন্য মতে, ‘যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন’, তাঁকে সনাতন হিন্দুরা মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। তাঁর অন্যান্য নামগুলো হচ্ছে চন্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুর সংহারিণী নারায়ণী, মহামায়া, কাত্যায়নী ইত্যাদি। দেবী দুর্গার অনেকগুলো হাত। তাঁর অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। তাঁর বাহন সিংহ (কোনো-কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুর মর্দিনী-মূর্তিতে তাঁকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরতা অবস্থায় দেখা যায়।

হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্য রূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলোতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয় দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলোর (দুর্গা পূজা) এবং তাঁর বিবাহিতা জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়।

দুর্গার আরাধনা বাংলা, অসম, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড এবং বিহারের কোনো-কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গা পূজা নবরাত্রি উৎসবরূপে উদ্যাপিত হয়। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে বাসন্তী দুর্গা পূজা। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম মহা আড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গা পূজার সূচনা করেছিলেন।

নানা রূপে দেবী
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবী সূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসেবেই মান্যতা দেয়া হয়। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজা বিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যে সকল পুরাণ ও উপ-পুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে: মৎস্যপুরাণ, মার্কন্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ ও দেবী ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চন্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন।

দেবী দুর্গা শাক্ত ধর্মে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় এবং শৈব ধর্মে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসেবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবতীকে দুর্গা হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেয়া হয়েছে, যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তি প্রদায়িনী। এসব ছাড়াও দুর্গা দেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়। দুর্গা দেবীর ভিন্ন-ভিন্ন অবতারসমূহ হচ্ছে: কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদÐিকা, সতী, পার্বতী, কৌশিকী ইত্যাদি।

বিদেশে
জাপানি দুর্গা বা ‘জুনতেই ক্যানন ((Juntei Kannon) ১৮ হাতের দুর্গা রূপ। মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে।

সিন্ধু সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই মাতৃপূজার। মাতৃপূজা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্না’র। কুশান রাজা কনিষ্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা’র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনো দেবী চন্ডী ‘বিবি নানা’ হিসেবে এসব অঞ্চলে পূজিত হন।

শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্য। এ সময়েই মার্কন্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবী মাহাত্ম্য গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্তি¡ক উপাদানগুলো একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমন্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে দেবী চন্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় দেবী চন্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে-সাথে। অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু ধর্মের হাত ধরে। এ সময় যে দুর্গা মূর্তিগুলো কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুর মর্দিনী। মূর্তিগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলি হচ্ছে, এখানে মহিষাসুর মর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন, যা তাঁর চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত।

জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতমটির তারিখ আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী।

ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ। ১৫শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরো পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে।

দুর্গা পূজা
দুর্গা পূজা হচ্ছে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা দেবীর উপাসনার উৎসব। দুর্গা পূজা শরৎ (আশ্বিন) এবং বসন্ত (চৈত্র) ঋতুর শুক্ল পক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কন্ডেয় চন্ডী অনুযায়ী, দুর্গা পূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে, রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি কর্তৃক। দেবী ভাগবত ও কালিকা পুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎ কালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গা পূজা করেছিলেন রাবণ বধের নিমিত্তে; এজন্য একে, ‘অকালবোধন’ও বলা হয়ে থাকে।
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ডে দুর্গা পূজা বহুলভাবে উদ্যাপন করা হয়; উত্তর ভারতে এটি নবরাত্রী হিসেবে পালন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র দুর্গা পূজা পালন করে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সকলে দুর্গা পূজা পালন করে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠী থেকে আরম্ভ ক’রে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে এই দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। এই পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামেও জানা যায়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, একে মহালয়াও বলা হয়ে থাকে; আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষী পূজার দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

নাম ব্যুৎপত্তি
হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:
‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত \
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত \’

অর্থাৎ, ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। শ্রীশ্রী চন্ডী অনুসারে যে দেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ (সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।