“ডিম সমাচার”

রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফঃ বিশ্ব ডিম দিবস (World Egg Day) প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে উদযাপিত হয়, যা ২০২৪ সালে ১১ অক্টোবর পালিত হবে। এই দিবসটি ডিমের পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা, এবং মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ডিমের অবদান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে পালিত হয়।

বিশ্ব ডিম দিবসের উদ্দেশ্য:
বিশ্ব ডিম দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ডিমের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই দিবসটি ডিম উৎপাদকদের জন্যও একটি বিশেষ দিন, যেখানে তারা ডিমের উৎপাদন এবং বিতরণে নিজেদের অবদান প্রদর্শন করতে পারেন। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে ডিম দিবসে আলোচনা সভা, প্রচারণা, এবং স্কুল-কলেজে শিক্ষামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিম দিবস:
বাংলাদেশে ডিম একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস। দেশের পোল্ট্রি শিল্প ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও, স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের ডিম গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কাজ করা হয়।

ডিম একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার হিসেবে পরিচিত, যা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এটি আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন এবং ভিটামিনসহ নানা উপকারি উপাদান সরবরাহ করে।

ক) ডিমের প্রধান পুষ্টিগুণঃ
ডিম একটি সম্পূর্ণ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, যা ৯টি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডসহ বহু ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ সরবরাহ করে। ডিমে থাকে ভিটামিন এ, ডি, ই, বি১২, রিবোফ্লাভিন, সেলেনিয়াম, এবং কোলিন, যা শরীরের শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের উন্নয়ন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিম হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা, পেশী বৃদ্ধির সহায়তা, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।

নিচে ডিমের প্রধান পুষ্টিগুণগুলো উল্লেখ করা হলো:

১. প্রোটিনের উৎস
• ডিম একটি চমৎকার প্রোটিনের উৎস। একটি মাঝারি আকারের ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম উচ্চমানের প্রোটিন থাকে। প্রোটিন আমাদের শরীরের কোষ গঠনে সহায়ক এবং পেশি মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
• প্রোটিনের পাশাপাশি ডিমে থাকা সমস্ত নয়টি অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড শরীরের বৃদ্ধি ও মেরামতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২. ভিটামিন এবং মিনারেলসমৃদ্ধ
• ডিমে ভিটামিন এ, ডি, ই, এবং বি কমপ্লেক্স (বিশেষত বি১২) থাকে। ভিটামিন বি১২ রক্তে লোহিত রক্তকণিকা গঠনে সাহায্য করে এবং স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখে।
• ভিটামিন ডি হাড় এবং দাঁত মজবুত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে।
• ডিমে ভিটামিন এ চোখের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।
৩. চর্বি
• ডিমে প্রায় ৫ গ্রাম স্বাস্থ্যকর চর্বি থাকে। এর মধ্যে স্যাচুরেটেড এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট উভয়ই রয়েছে। এগুলো শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে এবং কোষের গঠন বজায় রাখতে সহায়ক।
• ডিমের কুসুমে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী, এটি রক্তে কোলেস্টেরল কমাতে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে সহায়তা করে।
৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
• ডিমে থাকা লুটিন ও জেক্সানথিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি চোখের সুরক্ষায় কাজ করে এবং বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং ছানি প্রতিরোধে সহায়ক।
৫. মিনারেলসমূহ
• ডিমে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, এবং সেলেনিয়াম থাকে, যা হাড় মজবুত করে এবং দেহের বিভিন্ন কার্যক্রমে সাহায্য করে।
• সেলেনিয়াম একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৬. কোলিন
• ডিমে উচ্চমাত্রায় কোলিন থাকে, যা মস্তিষ্কের বিকাশ এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোলিন নার্ভ সিগন্যালিং এবং ফ্যাট মেটাবলিজমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৭. ক্যালোরি কম
• একটি মাঝারি আকারের ডিমে প্রায় ৭০-৭৭ ক্যালোরি থাকে, যা সঠিক পুষ্টি সরবরাহ করে কিন্তু ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৮. ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
• ডিম খেলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে, কারণ এর প্রোটিন এবং ফ্যাট যৌগগুলি হজমে ধীরে কাজ করে। ফলে ক্ষুধা কমে আসে এবং অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৯. হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য
• ডিমে থাকা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং ওমেগা-৩ হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম উন্নত করতে সহায়ক। যদিও ডিমের কুসুমে কোলেস্টেরল থাকে, তা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় না বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

খ) ডিমের বিভিন্ন অংশ এবং তাদের কাজ সম্পর্কে জানাঃ

চিত্রঃ ডিমের বিভিন্ন অংশ।

১. খোসা (Shell)
• কাঠামো ও রচনা: ডিমের বাইরের অংশটি ক্যালসিয়াম কার্বনেটের তৈরি শক্ত খোসা। এটি ডিমকে বাহ্যিক আঘাত থেকে রক্ষা করে এবং ভেতরের অংশকে সংরক্ষণ করে।
• কাজ: খোসা ডিমের ভেতরে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং বাইরের জীবাণু ও ময়লা থেকে ডিমকে রক্ষা করে। খোসায় ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে, যা দিয়ে বাতাস প্রবেশ ও নির্গত হয়, এটি ডিমের ভেতরে সঠিক বায়ুচলাচল নিশ্চিত করে।

২. ঝিল্লি (Shell Membrane)
• কাঠামো ও রচনা: খোসার ঠিক নিচে দুটি ঝিল্লি থাকে—একটি বাইরের খোসার সাথে লেগে থাকে এবং অন্যটি ভেতরের দিকে থাকে।
• কাজ: ঝিল্লিগুলো ডিমের অভ্যন্তরীণ অংশকে সুরক্ষা দেয় এবং মাইক্রোবস থেকে ডিমকে রক্ষা করে। যখন ডিম ঠাণ্ডা হয়, তখন ভেতরের ঝিল্লি সংকুচিত হয় এবং খোসার নিচে বায়ুর থলি তৈরি হয়।

৩. বায়ুর থলি (Air Cell)
• কাঠামো ও রচনা: ডিমের বায়ুর থলি ঝিল্লি এবং খোসার মধ্যে ফাঁকা স্থান। এটি ডিমের ঢালে থাকে এবং ডিম ঠাণ্ডা হওয়ার সময় গঠিত হয়।
• কাজ: ডিমের ভেতরে ভ্রূণের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রাথমিকভাবে এই বায়ুর থলি প্রয়োজন। ডিম পুরানো হলে বায়ুর থলি বড় হয়, যা ডিমের সতেজতা পরীক্ষা করতে সাহায্য করে।

৪. অ্যালবুমেন (Albumen বা Egg White)
• কাঠামো ও রচনা: ডিমের সাদা অংশটি মূলত পানি ও প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এটি ডিমের প্রায় ৫৮% অংশ দখল করে এবং দুটি স্তরে থাকে—পাতলা অ্যালবুমেন ও ঘন অ্যালবুমেন।
• কাজ: অ্যালবুমেন ভ্রূণকে সুরক্ষা দেয় এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। এটি ভ্রূণকে আঘাত থেকে রক্ষা করে এবং বাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন সরবরাহ করে।

৫. জর্মক চক্র (Chalazae)
• কাঠামো ও রচনা: দুটি সাদা স্ট্রিংয়ের মতো কাঠামো, যা ডিমের কুসুমকে কেন্দ্র স্থানে ধরে রাখে।
• কাজ: চ্যালাজা ডিমের কুসুমকে কেন্দ্রে স্থিত রাখতে সাহায্য করে, যাতে এটি ভ্রূণের বিকাশের সময় সঠিকভাবে স্থির থাকে এবং মাখনের মতো উপাদানের সাথে মিশে না যায়।

৬. কুসুম (Yolk)
• কাঠামো ও রচনা: ডিমের ভেতরের কেন্দ্রীয় অংশ, যা হলুদ বা কমলা রঙের। এতে প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন, মিনারেল, এবং কার্বোহাইড্রেট থাকে।
• কাজ: কুসুম ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য প্রধান পুষ্টি সরবরাহ করে। এটি পুষ্টির একটি বড় উৎস এবং ভ্রূণকে শক্তি যোগায়। কুসুমের ভেতরে ভ্রূণের প্রাথমিক কোষগুলি থাকে, যা ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার জন্য বিকাশ লাভ করে।

৭. জার্মিনাল ডিস্ক (Germinal Disc)
• কাঠামো ও রচনা: কুসুমের উপরিতল একটি ছোট সাদা দাগ থাকে, যা জার্মিনাল ডিস্ক নামে পরিচিত। এটি ডিমের ভ্রূণীয় অংশ।
• কাজ: এই জার্মিনাল ডিস্কের মাধ্যমে ডিম নিষিক্ত হলে এটি ভ্রূণের বিকাশ শুরু করে, যা শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চার রূপ নেয়।

৮. বাইরের পাতলা অ্যালবুমেন (Thin Outer Albumen)
• কাঠামো ও রচনা: এটি ডিমের সাদা অংশের একটি পাতলা স্তর, যা খোসার কাছে অবস্থিত।
• কাজ: এটি ডিমের সুরক্ষা ও ভ্রূণের পুষ্টি বজায় রাখতে সহায়ক।

৯. ঘন অ্যালবুমেন (Thick Albumen)
• কাঠামো ও রচনা: এটি অ্যালবুমেনের ঘন অংশ, যা কুসুমের চারপাশে থাকে।
• কাজ: ভ্রূণকে সুরক্ষা প্রদান এবং পুষ্টি সরবরাহ করার মূল উপাদান।

এই বিভিন্ন অংশ ডিমের সামগ্রিক কার্যকরী গঠন তৈরি করে এবং ডিমের ভ্রূণকে সঠিকভাবে বিকশিত হতে সহায়তা করে।

গ) ডিম উৎপাদন ও সিন্ডিকেটঃ
বাংলাদেশে ডিমের বাজার সম্প্রতি বেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যাকে 'ডিম সমাচার' বলা হচ্ছে। একদিকে ডিম উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদকরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, অন্যদিকে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।

ডিম উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পেছনে কিছু কারণ রয়েছে:
১) ফিডের দাম বৃদ্ধি: পোলট্রি ফিড বা খাদ্যের দাম বাড়ছে, যা উৎপাদন খরচে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
২) ইনফ্লেশন ও অন্যান্য খরচ: বিদ্যুৎ, জ্বালানি, এবং অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদকরা বেশি খরচের সম্মুখীন হচ্ছেন।
৩) রোগের প্রাদুর্ভাব: পোলট্রির মধ্যে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় টিকা এবং চিকিৎসার ব্যয়ও বেড়েছে।
৪) সিন্ডিকেটঃ অন্যদিকে, বাজারে ডিমের দামের ওপর সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যারা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের নাজেহাল করছে। এই সিন্ডিকেট ডিমের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা উচ্চ মূল্যে ডিম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

ঘ) করণীয়ঃ
ডিমের মূল্যবৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেটের কারণে ক্রেতাদের যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা মোকাবেলায় সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সমস্যার সমাধানে সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারে তা হলো:

১. উৎপাদন খরচ কমানো:
• পোলট্রি ফিডে ভর্তুকি: ফিডের দাম কমানোর জন্য সরকার ভর্তুকি দিতে পারে বা কাঁচামালের দাম কমানোর উদ্যোগ নিতে পারে। এতে উৎপাদকদের খরচ কমবে এবং তারা সাশ্রয়ী দামে ডিম সরবরাহ করতে পারবে।
• স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি ডিম উৎপাদকদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করে তাদের উৎপাদন খরচ কমানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
২. জরুরি আইন ও প্রয়োগ:
• মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু: অস্থায়ীভাবে ডিমের দাম নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে পারে। এটি করা হলে ক্রেতারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
• বাজার নজরদারি দল: একটি স্বতন্ত্র বাজার মনিটরিং দল গঠন করা যেতে পারে যারা ডিমের বাজার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে এবং কৃত্রিম সংকটের কারণে বাজারে অস্থিরতা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে।

৩. জনগণকে সচেতন করা: জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ: ডিমের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জনগণকে সচেতন করা এবং সিন্ডিকেট বা বাজারে কৃত্রিম সংকটের ক্ষেত্রে সরকারের হটলাইন বা অভিযোগ সিস্টেম চালু রাখা জরুরি।

৪. রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ: দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরই কেবল ডিম রপ্তানির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এতে করে দেশের বাজারে সংকট দেখা দেবে না।

৫. সরাসরি খামারিদের জন্য প্রণোদনা:
• টার্গেটেড ভর্তুকি: ফিড কোম্পানির মালিকদের বদলে সরাসরি খামারিদের জন্য ফিডের ওপর ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ফিড কেনার সময় খামারিদের জন্য বিশেষ ভর্তুকি দিতে পারে, যা তারা সরাসরি ব্যবহার করতে পারবেন।
• ডিজিটাল কুপন ব্যবস্থা: খামারিদের জন্য ফিড কেনায় একটি বিশেষ ডিজিটাল কুপন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যা সরকারিভাবে যাচাই করা খামারিরা ব্যবহার করতে পারবেন। এতে ফিড কোম্পানির মালিকরা মধ্যস্থতার সুযোগ পাবেন না এবং খামারিরা সরাসরি ফিডের দাম কমাতে সুবিধা পাবেন।

৬. সরাসরি খামারিদের ফিড উৎপাদনে সহায়তা: কোমিউনিটি বা সমবায় ভিত্তিক ফিড উৎপাদন: খামারিদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে সমবায় বা গ্রুপ তৈরি করে ফিড উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। এতে ফিড কোম্পানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং খামারিরা সরাসরি সাশ্রয়ী মূল্যে ফিড পেতে পারবেন।

৭. ফিড প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের সহায়তা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের নিজস্ব ফিড তৈরি করতে সহায়তা দিতে ছোট ফিড প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের জন্য সরকার ঋণ বা প্রণোদনা দিতে পারে।

৮. খামারিদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি:
• নিজস্ব ফিড প্রস্তুতিতে প্রশিক্ষণ: খামারিদের নিজেরাই ফিড প্রস্তুত করতে এবং সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহার করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। সরকারী উদ্যোগে গবেষণার মাধ্যমে সাশ্রয়ী ফিডের ফর্মুলা বের করা যেতে পারে যা খামারিরা সহজে ব্যবহার করতে পারবেন।
খামারিদের জন্য সরাসরি ক্রেডিট সুবিধা:
• স্বল্প সুদে ঋণ: সরকার খামারিদের সরাসরি স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করতে পারে, যাতে তারা বেশি উৎপাদন করতে পারেন এবং ব্যয় কমাতে সক্ষম হন।

৯. ফিডের কাঁচামালে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ:
• কাঁচামালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ: ফিড উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের (যেমন সয়াবিন, ভুট্টা ইত্যাদি) বাজারে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে, যাতে ফিড উৎপাদনের খরচ কমানো যায়। এর ফলে ফিড কোম্পানিরাও কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াতে পারবে না।
• আন্তর্জাতিক কাঁচামাল আমদানি সহজ করা: কাঁচামাল আমদানি শুল্ক বা অন্যান্য বিধিনিষেধ কমিয়ে এনে কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যায়, ফলে স্থানীয় ফিড উৎপাদন খরচ কমবে।

১০. স্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রকাশ:
• ফিডের খরচের ওপর নিয়মিত মূল্য যাচাই: ফিড কোম্পানিরা যেন কৃত্রিমভাবে মূল্য না বাড়াতে পারে, সেজন্য নিয়মিত মূল্য যাচাই এবং খরচ পর্যালোচনা করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর ফলে ফিডের দামের পেছনে যথাযথ কারণ না থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
• সরাসরি মূল্য তত্ত্বাবধান: সরকার ফিড কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সরাসরি উৎপাদন খরচের তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করতে পারে। এতে ফিডের দাম স্বচ্ছ থাকবে এবং কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ কমবে।

১১. সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কঠোর পদক্ষেপ:
• বাজার মনিটরিং: সরকারকে নিয়মিতভাবে ডিমের বাজারের ওপর কঠোর নজরদারি করতে হবে এবং সিন্ডিকেটের প্রভাব খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
• অ্যান্টি-ট্রাস্ট ল' বা প্রতিযোগিতা আইন প্রয়োগ: বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট করে যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তি হিসেবে জরিমানা বা লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে।

১২. সুষম সরবরাহ নিশ্চিত করা:
• সরকারি সংরক্ষণ কেন্দ্র বা স্টোরেজ ব্যবস্থা: ডিমের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করার জন্য সরকারি স্টোরেজ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ফলে সংকট সৃষ্টি করে সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
• বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি: ডিম উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের উৎপাদকদের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ডিমের আমদানি শুল্ক কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

১৩. ফিড কোম্পানির উপর মনিটরিং এবং নিয়ন্ত্রণ:
• ফিডের দাম নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণ: ফিড কোম্পানির উপর কড়া নজরদারি বসানো যাতে তারা অসাধু উপায়ে দাম বাড়াতে না পারে। এই মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর হলে ফিডের দাম স্থিতিশীল রাখা যাবে।
• ফিড কোম্পানির উপর করছাড় বা প্রণোদনা শর্তযুক্ত করা: ফিড কোম্পানিগুলো যদি সরকারের প্রণোদনা বা ভর্তুকি পায়, তবে তাদের শর্তসাপেক্ষে কৃষকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে ফিড বিক্রি করতে বাধ্য করা যেতে পারে।

উপসংহার

ডিম একটি পুষ্টিকর খাবার যা প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। এটি চোখ, মস্তিষ্ক, হাড়, এবং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। নিয়মিতভাবে ডিম খাওয়া পুষ্টির ঘাটতি পূরণ এবং শরীরের সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারী নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদন খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ফিড কোম্পানির মালিকরা লাভবান না হয়ে সরাসরি খামারিরা সুবিধা পাবেন, এবং এর ফলে ডিমের উৎপাদন খরচ কমে ডিমের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে। সর্বোপরি, ডিমের বাজার পরিস্থিতিতে ক্রেতারা, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হস্তক্ষেপ এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।

লেখকঃ ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারি অফিসার, ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস), সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দলোন (বাপা) রাজশাহী, সভাপতি (২০২৩-২৪), রোটারি ক্লাব অফ রাজশাহী সেন্ট্রাল; যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সম্পাদক সুজন, (রাজশাহী মেট্রোপলিটন) এবং সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী।
=================