রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ
ভূমিকা:
এন্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) বর্তমান বিশ্বের একটি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য এন্টি মাইক্রোবিয়াল ওষুধের অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলি ক্রমশ এই ওষুধগুলোর প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, যা ভবিষ্যতের চিকিৎসা ব্যবস্থা সংকটে ফেলতে পারে। প্রতি বছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর পালিত হয় বিশ্ব এন্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) সচেতনতা সপ্তাহ। ২০২৪ সালের এই সপ্তাহের থিম "Educate. Advocate. Act Now" এই সমস্যার বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বৈশ্বিক প্রচারণার আহ্বান জানায়।
এন্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) কী?
AMR হল সেই পরিস্থিতি যেখানে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস এবং অন্যান্য জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য এন্টি মাইক্রোবিয়াল ওষুধের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এর ফলে সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহৃত প্রচলিত ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ সেবন।
- প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের অযথা ব্যবহার।
- যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা।
- পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিক দূষণ।
AMR এর ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী হাসপাতালে ভর্তি, এবং প্রতিরোধযোগ্য সংক্রমণের কারণে মৃত্যুর হার বাড়ছে।
থিম: "Educate. Advocate. Act Now"
২০২৪ সালের এই থিম তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে:
- Educate (শিক্ষা):
- AMR সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া।
- চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, কৃষিজীবী, এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- Advocate (উপস্থাপন):
- নীতিনির্ধারকদের কাছে AMR প্রতিরোধে নীতি প্রণয়ন এবং কঠোর নিয়ম কার্যকরের জন্য আহ্বান জানানো।
- নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এবং চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারে গবেষণাকে উৎসাহিত করা।
- Act Now (এখনই পদক্ষেপ নিন):
- প্রত্যেক খাতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের যথাযথ নিয়ম অনুসরণ নিশ্চিত করা।
- "One Health" পদ্ধতি অনুযায়ী মানব স্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ এবং পরিবেশ খাতের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ।
AMR প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বিষয়সমূহ
১. AMR এর প্রভাব:
AMR এর কারণে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে:
- স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধি: দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ও অতিরিক্ত ওষুধের প্রয়োজনীয়তা।
- মৃত্যুহার বৃদ্ধি: অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ায় সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।
- সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি: দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার ফলে কর্মক্ষম জনশক্তির ক্ষতি।
২. অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা:
- সংক্রমণের সঠিক নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ।
- ডোজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা।
- অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন বন্ধ করা।
৩. কৃষি ও প্রাণিসম্পদে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার:
- প্রাণিসম্পদ খাতে অ্যান্টিবায়োটিক অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হচ্ছে।
- সমাধান:
- সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকাদান ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
- বিকল্প পদ্ধতির (যেমন: প্রোবায়োটিক ব্যবহার) প্রচলন।
৪. নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এবং চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার:
- AMR এর ফলে বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা কমে আসছে।
- জরুরি ভিত্তিতে নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য গবেষণা বাড়ানো প্রয়োজন।
৫. জনসচেতনতা প্রচারণা:
- গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা।
- "One Health" পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরা।
৬. নীতিমালা এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ:
- অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কড়া নিয়ন্ত্রণ।
- সংক্রমণ পর্যবেক্ষণের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ।
- গবেষণা খাতে সরকারি এবং বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
"One Health" পদ্ধতি এবং AMR প্রতিরোধ:
"One Health" ধারণা অনুযায়ী AMR প্রতিরোধে মানব স্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ, এবং পরিবেশ খাতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
- মানব স্বাস্থ্য: সঠিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিধি।
- প্রাণিসম্পদ: অ্যান্টিবায়োটিকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।
- পরিবেশ: অ্যান্টিবায়োটিক বর্জ্যের দূষণ রোধ।
উপসংহার:
বিশ্বব্যাপী এন্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলায় প্রত্যেকের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালের থিম "Educate. Advocate. Act Now" সবাইকে একত্রিতভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়। শিক্ষা, সচেতনতা, এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে AMR প্রতিরোধ সম্ভব। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসি।
লেখক: ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারি অফিসার, ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস) সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দলোন (বাপা) রাজশাহী, আইপিপি, রোটারী ক্লাব অব রাজশাহী সেন্ট্রোল, যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সম্পাদক সুজন, (রাজশাহী মেট্রোপলিটন), ও সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী।