"বি.এল.এস-এর পতাকা তলে আসবে সবাই দলে দলে, থাকবে না কেউ বেকার।"
রোটারিয়ান ড মো হেমায়েতুল ইসলাম আরিফঃ
সাধারন আলোচনা
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং তাদের জীবিকা মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদ খাত কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দেশের অর্থনীতি, পুষ্টি চাহিদা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষিখাতের অবদান ১৫.৩৩% এবং দেশের ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান এই খাতের মাধ্যমে হয়।
তবে, আধুনিক কৃষি পদ্ধতির বিস্তারের পরও আমাদের প্রাণিসম্পদ খাত এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, দক্ষ জনশক্তির অভাব, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, এবং গবেষণার অভাব এই খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে এবং প্রাণিসম্পদ খাতকে টেকসইভাবে এগিয়ে নিতে ২০১২ সালে বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বি.এল.এস) প্রতিষ্ঠিত হয়।
১. বি.এল.এস এর সূচনা ও ভিশন (২০১২)
২০১২ সালের ৭ জানুয়ারি প্রাণিসম্পদ খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বি.এল.এস) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল একটি টেকসই এবং আধুনিক প্রাণিসম্পদ খাত গড়ে তোলা, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ভিশন:
• প্রাণিসম্পদ খাতকে আধুনিক ও টেকসই খাতে রূপান্তর করা।
• কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা।
• নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্য নিশ্চিত করা।
• প্রযুক্তির ব্যবহার ও গবেষণা সম্প্রসারণ।
২. বি.এল.এস এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
২.১ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন:
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাতকে সমৃদ্ধ করতে কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন।
২.২ দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তা:
দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণিসম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং তাৎপর্য তুলে ধরা।
২.৩ প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা:
প্রাণিসম্পদ খাতে আধুনিক প্রশিক্ষণ, গবেষণা এবং প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
২.৪ খামার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন:
লাইভস্টক ভিলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা চালু করা।
২.৫ সচেতনতা বৃদ্ধি:
প্রাণিসম্পদ খাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ।
৩. প্রথম পর্যায়: ২০১৩-২০১৫ (প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান)
২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল বি.এল.এস-এর ভিত্তি গড়ে তোলার সময়। এই সময়ে সংগঠনটি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করে:
• বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন।
• গবাদি পশুর রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি।
• নতুন খামার স্থাপনে আর্থিক সহযোগিতা।
• আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ।
এই সময়ে শত শত খামারিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
৪. দ্বিতীয় পর্যায়: ২০১৬-২০১৮ (প্রযুক্তির প্রয়োগ ও গবেষণা)
২০১৬ সাল থেকে বি.এল.এস গবেষণা এবং প্রযুক্তির প্রয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়।
• আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দুধ এবং মাংস উৎপাদন।
• নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা।
• কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
২০১৭ সালে নিরাপদ দুধ এবং মাংস উৎপাদনে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো হয়।
৫. তৃতীয় পর্যায়: ২০১৯-২০২০ (কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলা)
কোভিড-১৯ মহামারির সময় বি.এল.এস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
• বিনামূল্যে গবাদিপশুর চিকিৎসা সেবা।
• খামারিদের মাঝে মুরগির বাচ্চা এবং খাদ্য বিতরণ।
• খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
এই সংকটময় সময়ে সংগঠনের কার্যক্রম প্রশংসিত হয় এবং খামারিদের জন্য ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
৬. চতুর্থ পর্যায়: ২০২১-২০২৩ (নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে অগ্রসরতা)
২০২১ সাল থেকে বি.এল.এস নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ শুরু করে:
• "প্রাণিসম্পদ নীতি ২০২১" বাস্তবায়নে সুপারিশ।
• ৫ম লাইভস্টক অ্যাওয়ার্ড এবং মেলা।
• পোল্ট্রি এবং দুগ্ধ শিল্পে গবেষণা সম্প্রসারণ।
এই সময়ে খামারিদের দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
৭. পঞ্চম পর্যায়: ২০২৪ (প্রোটিন ঘাটতি দূরীকরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি)
২০২৪ সালে বি.এল.এস এর লক্ষ্য ছিল:
• প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ।
• খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
• কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান।
২০২৪ সালের উল্লেখযোগ্য অর্জন:
• ৭০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা।
• রোটারি ক্লাবের সাথে যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন।
৮. ভবিষ্যৎ দিগন্ত: ২০২৫
২০২৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা:
• আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
• নতুন গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা।
• ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খামার ব্যবস্থাপনা।
৯. সাফল্যের চিত্র
• অসংখ্য খামারি প্রশিক্ষণ প্রদান ।
• ৫টি গবেষনা জার্নাল প্রকাশনা এর মাধ্যমে ৫০টির অধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ ।
• টেকসই প্রাণিসম্পদ নীতি বাস্তবায়ন।
• কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সংঘ ও প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা প্রদান।
১০. উপসংহার
বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বি.এল.এস) ২০১২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। এই সময়ে সংগঠনটি প্রশিক্ষণ, গবেষণা, সচেতনতা এবং প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে।
"বি.এল.এস এর পতাকা তলে আসবে সবাই দলে দলে, থাকবে না কেউ বেকার।" এই আদর্শকে সামনে রেখে বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি ভবিষ্যতেও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একযুগের সফল পথচলায় আমাদের সঙ্গে থাকা সকল জীবন সদস্য, সাধারণ সদস্য, সহযোগী সংগঠন, শুভানুধ্যায়ী এবং এই পথচলার অংশীদার সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আপনাদের অবিরাম সমর্থন এবং অংশগ্রহণ আমাদেরকে আরও এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বি এল এস)