ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন: আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস। বিশ্বে অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও বিশ্ব বেতার দিবসটি পালিত হবে যথাযথ মর্যাদার সাথে। বাংলাদেশ বেতার এ উপলক্ষে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া বেতারের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রোতা ক্লাবও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বেতার বর্তমান বিশ্বের যোগাযোগের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। সমাজ উন্নয়ন, দুর্যোগ, শিক্ষা, সংবাদ ও বিনোদনের বিশেষ বাহন হিসেবে কাজ করছে বেতার।
তথ্য সরবরাহকে গণমানুষের কাছে আরো বিস্তৃতির প্রয়াসে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পালন করা হয়। স্পেনের অনুরোধে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ইউনেস্কো ২০০৮ সাল থেকে দিবসটি পালন করে আসছে। প্রথমে দিবসটি ৩০ অক্টোবর নির্ধারণ করলেও ২০১১ সালে ইউনেস্কোর এক্সিকিউটিভ বোর্ড ১৩ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পুনর্র্নিধারণ করে। ২০১২ সালেই সর্বপ্রথম বিশ্বব্যাপী আড়ম্বড়তার সাথে বেতার দিবস পালন করা হয়। একই বছরে আন্তর্জাতিক রেডিও কমিটি নামক একটি কমিটি গঠিত হয়। বেতারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, বেতারের মাধ্যমে অবাধ তথ্য পাওয়ার সুবিধা এবং ব্রডকাস্টারদের মধ্যে যথাযথ সংযোগ বাড়ানোই এ দিবসের মূল লক্ষ্য।
বেতার হল শ্রোতাদের প্রাণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে সামাজিক যোগাযোগের পাশাপাশি মানসম্মত বেতার এখনও বেশ জনপ্রিয়। ২০২৫ সাল জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়, তবে গ্রিণহাউস গ্যাসের নিঃসরণ অবশ্যই আটকাতে হবে এবংপরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা কমাতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বিশ্ব বেতার দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বেতার ও জলবায়ু পরিবর্তন’। পরিবেশ রক্ষার ধারণা জনপ্রিয় করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে শ্রোতাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করতে বেতার এখন সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে শ্রোতাদের অসীম জ্ঞান রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষ এবং আদিবাসি, যারা নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরিবেশগত দুর্যোগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিত্য নতুন সমস্যাকে মোকাবেলা করছেন, তাদের কথা বেতারে আরো যত বেশি তুলে ধরা যাবে ততই বেতার এগিয়ে যাবে। বেতার তার অসাধারণ শক্তি নিয়ে আজও গণমাধ্যম জগতে সবার উপরে আসন ধরে আছে, তাই এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে।
বেতার আমাদের গর্বিত অহংকারের আলোকিত বাতিঘর। অনেকেরই ধারণা আইসিটি বা ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার এ সময়ে বেতার তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ধারণাটি সঠিক নয় মোটেই। কারণ সময় যেমন বদলেছে, ঠিক তেমনই সময়ের সাথে তালমিলিয়ে প্রচারণার ধরনও বদলে গেছে। এখনও মানুষ বেতার শোনে। এখনও বেতারের ওপর নির্ভর করে অনেক মানুষ তাদের জীবন নির্বাহ করে। বিশেষ করে দুর্যোগ দুর্বিপাকে যখন অন্য সব মিডিয়াগুলো স্থবির স্তব্ধ হয়ে যায় তখনও বেতার সেবা দিযে যায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে। গ্রামের বা শহরের কৃষক, মজুর, শ্রমিক, মেহনতি মানুষগুলো এখনো রেডিওকে তাদের বিনোদনের প্রধান এবং বিশেষ ভরসার মাধ্যম হিসেবে মনে করে। সত্যিকারার্থে পুরোবিশে^ই বেতার এখনও অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম। বেতারের রয়েছে দুর্গমস্থানে পৌঁছানোর শক্তি। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সম্প্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এখনও বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম হিসেবে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে।
রেডিওর গুরুত্ব আছে বলেই বাংলাদেশে ৩০টির মতো প্রাইভেট এফএম এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও এফএম অনুমোদিত হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেতার ১২টি আঞ্চলিক বেতারকেন্দ্র্র এবং ৩৫টি এফএম কার্যক্রম পরিচালনা করছে দেশব্যাপী। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪ টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতার প্রতিদিন ২৮০ ঘণ্টার মতো বিভিন্ন আঙ্গিকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আঞ্চলিক কেন্দ্র্র্রগুলো হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, বান্দারবান ও কুমিল্লা। এছাড়া অনুষ্ঠান প্রচারে ইউনিটগুলো হচ্ছে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস, বহির্বিশ্ব কার্যক্রম, বাণিজ্যিক কার্যক্রম, কৃষি বিষয়ক কার্যক্রম, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেল এবং ট্রাফিক সম্প্রচার কার্যক্রম এবং আরো কতগুলো ইউনিট।
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বেতারের বিরামহীন সম্প্রচার মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বেতারের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের সবারই জানা। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে গণমানুষকে উদ্বুদ্ব ও উৎসাহিত করতে বেতার শক্তিশালী হাতিয়ার। এ ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ সম্পাদন করা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেতারের ভূমিকা অনন্য। সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, রোয়ানুর মতো বিভিন্ন দুর্যোগের সময় কমিউনিটি বেতারের কর্মীবাহিনী বিরামহীন নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য প্রদান করে দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। তাছাড়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিনোদন ও তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষের আচরণগত পরিবর্তনেও বেতার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে গর্বের সাথে। শুধু কী তাই, মানুষের যাপিত জীবনে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারীসহ নানা প্রকৃতিক দুর্যোগে প্রকৃত বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ বেতার। এখনো অবিরাম তথ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ বেতার দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য সব সময় সব কাজে।
আর কমিউনিটি রেডিওগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামবাংলার তৃণমূল কার্যক্রমকে তুলে ধরছে উন্নয়নে, সহমর্মিতায়, সহযোগিতায়, সুন্দরে, সফলতায় আর সমৃদ্ধিতে। সব মিলিয়ে রেডিওর প্রচার কার্যকারিতা দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে দক্ষতা যোগ্যতা আর একনিষ্ঠ শ্রোতাবান্ধব হিসেবে। এ ছাড়া যৌতুক, বাল্যবিয়ে, দুস্থ মানবতার সেবা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সামাজিক উন্নয়ন, আত্মহত্যা, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ কৃষি উন্নয়ন, নিরাপদ খাদ্য, আবহাওয়া-জলবায়ু, আইসিটি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, শিক্ষা, পুষ্টি, বিনোদন বিষয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং একটা মাত্রিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে গুরুত্ব দিয়ে বেতার এখন তৈরি করছে নিত্য নতুন অনুষ্ঠানমালা যেখানে তরুণরা তাদের অংশগ্রহণের একটি প্ল্যাটফরমও খুঁজে পেয়েছে।
বেতার আছে বেতার থাকবে। দেশের জনগণের নিত্য চাহিদা মেটানোর জন্য বেতার অনন্য আবশ্যকীয়। আমাদের উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে বেতারের বিকল্প নেই। সেজন্য বেতারকে বিশেষ করে কমিউনিটি রেডিওগুলোকে দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে আরো বেশি সক্ষম করতে পারলে অভাবণীয় সফলতা এনে দেবে এসব কমিউনিটি রেডিও। বহিবিশে^র সাথে তাল মিলাতে গেলে বেতারের এখনো অনেক আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এছাড়া বাজারের অবস্থা বুঝে শিল্পী ও কলাকুশলীদের সম্মাননা বৃদ্ধি করতে না পারলে ভালো মানের শিল্পী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করে বাংলাদেশ বেতারসহ কমিউনিটি রেডিওগুলো এগিয়ে যাবে এই শুভ সুন্দরের অপেক্ষায় রইলাম। বাংলাদেশ বেতার তার সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ুু পরিবর্তনের অভিঘাতকে মোকাবেলা করার জন্য আরো বেশি মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
*লেখক: অধ্যাপক, কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা