সার বীজের উচ্চমুল্যে দিশেহারা কৃষক

ড. এম মনির উদ্দিনঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ, যেখানে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি শুধু এদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডই নয়, এটি দেশের ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম মুল ভিত্তি। অথচ, দেশের কৃষি খাতের তথা খাদ্য উৎপাদনের মুল চালিকা শক্তি কৃষকদের জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।

কৃষক কৃষিকাজ করে তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন না নিয়ে আসতে পারে তার জন্য তাদের চারপাশে ঘিরে আছে স্থানীয় মহাজন, উচ্চ সুদে ঋন প্রদানকারী এনজিও, আড়তদার থেকে শুরু করে দেশী বিদেশী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ফসল ফলায় যে কৃষক সেই কৃষকের ঘরেই খাবার থাকে না, ছেলে-মেয়েদের অসুখ হলে ঔষধ কেনার পয়সা থাকে না অথচ জমিতে ফসল ফলানোর সময় হলে সেই কৃষক যেন অস্থির হয়ে যায় কিভাবে জমিতে ফসল ফলানোর অর্থ যোগাবে। এইভাবে কৃষক দ্বারস্থ হয় স্থানীয় মহাজন, ঋন প্রদানকারী এনজিও, কৃষক সেবা নামদারী কিছু স্টার্ট আপ এর কাছে এবং চড়াসুদে টাকা যোগাড় করে জমিতে ফসল ফলানোর উদ্যোগ নেয়।

এভাবে চড়াসুদে টাকা ঋন নিয়ে কৃষক যখন ডিলারের দোকানে সার কিনতে যাচ্ছে তখন তাকে ১০৫০ টাকার ডিএপি সার কিনতে হচ্ছে ১৫০০-১৮০০ টাকায় যদিও ডিলারের দোকানে বিভিন্ন সারের সরকার নির্ধারিত একটি মুল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখা আছে যার কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই। এত কষ্ট করে পর পর কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে ফসল নষ্ট হওয়ার পর কৃষক যখন তার ফসল বাজারে নিয়ে আসছে তখন আরেক কষ্টদায়ক ও করুণ চিত্র। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, মিডিয়ায়, পত্র পত্রিকায় উঠে এসেছে শীতকালীন সব্জির মুল্য। কৃষককে একমন ফুলকপি বিক্রয় করতে হয়েছে ৪০-৮০ টাকায় অথচ যার একটি চারার দাম পড়েছে ২ টাকা আর একটি ফুলকপির মোট উৎপাদন খরচ পড়েছে কমপক্ষে ১৫ টাকা। ছোটবেলায় বাবা একটি গল্প শুনিয়েছিলো যার একটু অংশ এই রকম; কোন এক দেশে কলার হালি বিক্রয় হয় চার আনায় আবার কলা খাওয়ার পর তার খোসার হালিও বিক্রয় হয় চার আনায়’। বাবার সেই গল্পের অর্থ যদি আজকে খুজি তাহলে সেই দেশটি ছিলো কোন নিয়ম নীতিহীন। আমাদের দেশের কৃষি এবং কৃষকের অবস্থা যদি পর্যবেক্ষন করি তাহলে বলতেই হয় যে কোন নিয়ম নীতি ছাড়াই চলছে দেশের কৃষি।

দেশের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক জানালেন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে এক কেজি মিষ্টি কুমড়ার বীজ কিনে রশিদ চাইলে বীজ বিক্রয়কারী ডিলার কোন রশিদ দেয় না। এই উচ্চ দামে বীজ কিনে অনেকেই পায়নি কাংখিত ফলন এমনকি পুরোটাই নষ্ট হয়েছে কিন্তু দোকানদার, স্থানীয় কৃষি অফিসে গিয়েও পাওয়া যায়নি কোন প্রতিকার। এভাবেই, এই মৌসুমে কৃষক ভুট্টার বীজ কিনেছে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা কেজি, ধানের হাইব্রিড বীজ সর্বোচ্চ ৫২০ টাকা কেজি, পেয়াজের বীজ ৮ হাজার টাকা কেজি দরে।

এইভাবে, ভেজাল সার আর ভেজাল বীজের খপ্পরে পড়ে এমনিতেই কৃষক নাজেহাল তারপরেও ফসল ফলিয়ে বিক্রয় করতে হয় পানির চেয়েও কমদামে। এভাবে, কতোদিন কৃষক নিজে ভুর্তকি দিয়ে কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে? কৃষকের এই দুরাবস্থা শুধু তাদের জীবনযাত্রাকেই সংকটাপন্ন করছে না, এটি দেশের আগামীদিনের খাদ্য নিরাপত্তার উপরও মারাত্বক প্রভাব ফেলছে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত।

কৃষককে সরকার ভর্তুকি মুল্যে সার দেয় এবং মনে করা হয় কৃষককে বাঁচানো হলো ভর্তুকি মুল্যে সার দিয়ে। অথচ, কেউ ভাবেনা বা উপলদ্ধি করে না যে কৃষক বেশী মুল্য দিয়ে সার কিনতে না পারলে দেশের ১৮ কোটি মানুষ যে খাবার খায় তা কোথা থেকে আসতো। এদেশে একটি বিষয় প্রচলিত হয়ে গেছে যে, কৃষক যেভাবেই হোক ফসল ফলাবে আর ভোক্তারা তা কম দাম দিয়ে কিনে খাবে। বীজ ব্যবসায়ীরা তাদের নিজের মতো করে দেশীয় বা আমদানীকৃত বীজের দাম নিজেরাই নির্ধারন করে বাজারে বিক্রয় করছে। পেস্টিসাইড ব্যবসায়ীরা তাদের মতো করে দাম নির্ধারন করে বাজারে পেস্টিসাইড বিক্রি করছে। ফিড ব্যবসায়ীরা তাদের মতো করে ফিড বিক্রয় করছে, মুরগীর বাচ্চা উৎপাদনকারীরা ইচ্ছেমতো দামে বাচ্চা বিক্রয় করছে।

অর্থাৎ কৃষির প্রয়োজনীয় প্রতিটি উপকরণ কৃষক বা খামারীরা বাজার থেকে উচ্চদামে কিনে ফসল ফলিয়ে যখন ফসল তোলার সময় হয় বা কৃষক যখন বাজারে নিয়ে যায় তখন কৃষকের সকল উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারন করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এভাবে, কৃষকেরা তাদের ফসল বিক্রি করে প্রতিনিয়ত লোকসানের মুখে পড়ছে এবং এহেন পরিস্থিতিতে কৃষক তার সন্তানদেরকে কৃষিকাজে উৎসাহিত না করে বিকল্প কাজে নিয়োজিত করছে। এর কারনে, গ্রামের অধিকাংশ ছেলেরা দেশের বাইরে পারি জমাচ্ছে এবং সেখানে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করে সংসারের খরচ পাঠাচ্ছে। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে যে, বিদেশে গিয়ে এ সকল তরুনরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে কিন্তু কৃষি থেকে দিন দিন যে তরুন সমাজ মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে এবং আগামীদিনের কৃষিকে সচল রাখার জন্য আমাদের সামনে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ কিন্তু তৈরী হচ্ছে।

দেশের কৃষিকে যদি সঠিকভাবে চালানো না যায়, কৃষক তার কৃষিকে যদি ব্যবসায়িকভাবে দাঁড় করাতে না পারে, কৃষক যদি শুধু লোকসান গুনতেই থাকে তাহলে একটি সময়ে কৃষক কিন্তু হতাশ হয়ে পড়বে। আর, কৃষক যদি কৃষিকে চালাতে না পারে বা লোকসান দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যায় তখন কিন্তু দেশে শুধু খাদ্য সংকটই তৈরী হবেনা। সেইসাথে, কৃষকের চারপাশে আজকে যারা ব্যবসা করে কৃষকের লাভ সবটুকু হাতিয়ে নিচ্ছে তারাও কিন্তু ব্যবসা করতে পারবেনা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য সরকারকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে কৃষকের পাশে দাড়াতে হবে। বিগতদিনে সরকারের কৃষিমন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা এবং অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেভাবে বিদেশ থেকে কম দামে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে এনে ভর্তুকির নামে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন জগন্য কার্যক্রম যেন না চলে তার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। কৃষি উপকরণ, মেশিনারীজ এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে ভর্তুকি বাড়ানোর পাশাপাশি, সেগুলোর সঠিক বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।

বেসরকারী পর্যায়ে যে সকল প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে সার আমদানি করে থাকে, তারা সত্যিকার অর্থে সঠিক পরিমানে সার দেশে আনছেন কিনা নাকি ভর্তুকির টাকা পেতে শুধু এলসি খুলছেন অথবা আমদানির নামে বিদেশে টাকা পাচার করছেন এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। তবে, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সকল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নিমিত্তে দেশের সকল ধানচাষী কৃষকদের ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার এবং মেশিনারী সাপোর্ট বিশেষ করে চারা রোপন এবং ফসল কাটার সহায়তা বিনামুল্যে প্রদান করা দরকার।

কারন, বর্তমানে ধান উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষককে যে খরচ করতে হচ্ছে আর ধান যে দামে বিক্রয় হচ্ছে তাতে কোনভাবেই কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। বর্তমান পদ্ধতিতে, কৃষকদেরকে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় যে প্রনোদনা দেয়া হচ্ছে তা উপর থেকে কৃষক পর্যায়ে কতটুকু পাচ্ছে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বরং, আমার জানামতে কৃষক প্রনোদনার আওতায় ফসলের বীজ পেয়ে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কারন কৃষককে অবীজ দেয়া হয়েছে অর্থ্যাৎ যা বীজ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়।

কৃষকদের প্রতি এই ধরনের উদাসীনতা বা প্রতারনা শুধু তাদের জীবনে নয়, পুরো জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই, কৃষকদের পাশে দাড়ানো এবং তাদের এই অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দেশ প্রেমের প্রতি সম্মান জানানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। দেশের কৃষিখাতের সঠিক উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন যার মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি উৎপাদন খরচ কমানোর প্রযুক্তি, কৃষকদের বীজ ও সার নিশ্চিতকরন, যান্ত্রিকিকরন এবং পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকের পন্যের সঠিক মুল্য প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আগামীদিনের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তরুনদেরকে উৎপাদনমুখী করতে, তাদেরকে কৃষিতে আগ্রহী করতে, একজন দক্ষ ও সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারে একমাত্র কৃষি। তাই, কৃষিকে ঘিরেই দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন করার পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক পরিকল্পনা করা হবে একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

কৃষককে ঘিরে যে শোষনবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙ্গে দিয়ে কৃষক ও কৃষি বান্ধব একটি উৎপাদন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরী। সেইসাথে, কৃষির সাথে জড়িত সরকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে আসতে হবে স্বচ্ছতার আওতায়। সামগ্রিকভাবে, দেশের কৃষি খাতের উন্নয়ন শুধুমাত্র কৃষকদের জীবনমান উন্নত করবে না, বরং এটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার একমাত্র উপায়। দেশের কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি তরুন সমাজকে কৃষিতে নিয়ে আসতে পারলে দেশের বহুমুখী কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ফলে, বিদেশ নির্ভর কৃষিপণ্যের আমদানি ব্যয় কমে যাবে, দেশের কৃষিকে ঘিরে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরী হবে। তাই, কৃষকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত পরিবেশ গড়ে তোলা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

লেখক:এগ্রোনমিস্ট ও কলামিস্ট