শত্রুতা করে ফসল নষ্ট করলে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড

সমীরণ বিশ্বাস:বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নৈতিকতার সংকট, লোভ-লালসা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারণে নিরপরাধ গাছপালা, ফসল, ও পরিবেশের ওপর মানুষের নিষ্ঠুরতা দিন দিন বাড়ছে। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ও জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি খাতকে হুমকির মুখে ফেলছে, অন্যদিকে মানুষের স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ড কৃষিজমি ও পরিবেশের জন্য আরও বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

সমস্যার মূল কারণ:

লোভ ও লালসা: ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে কৃষিজমি দখল, অবৈধ নির্মাণ, এবং বন উজাড় করা হচ্ছে। জমির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক অসাধু চক্র পরিকল্পিতভাবে কৃষিজমির ক্ষতি করছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা: কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য ফসল ধ্বংস করা হতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে তাদের কৃষিজমি, ফলের বাগান বা ফসলি জমি নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও প্রভাব ফেলছে।

সামাজিক অবক্ষয়: আইনের শিথিলতা, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব, এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে অনেকেই গাছপালা ও ফসলের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালাচ্ছে।

ব্যক্তিগত শত্রুতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা: ব্যক্তিগত শত্রুতা বা প্রতিশোধ নিতে অনেক সময় ফসলি জমি নষ্ট করা হয়, বাগানের গাছ কেটে ফেলা হয়, এমনকি বিষ প্রয়োগ করেও ফসল ধ্বংস করা হয়। এটি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির নয়, পুরো কৃষি অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

ভুল নীতি ও অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত : কখনো কখনো সরকার বা সংস্থার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়। যেমন—অবৈধভাবে কৃষি জমি দখল, কৃষকদের ন্যায্য মূল্য না দেওয়া, বা ভুল সময়ে আমদানি-রপ্তানি নীতি গ্রহণ করা।

কৃষকদের প্রতিবাদ: অনেক সময় কৃষকেরা ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় বা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিজেরাই ফসল ধ্বংস করতে বাধ্য হন। এটি একটি কঠিন বাস্তবতা যেখানে কৃষকের কষ্টের ফল মূল্যহীন হয়ে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত অবহেলা : মানুষের পরিবেশ দূষণ ও বন উজাড়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, যার ফলে খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি ফসল ধ্বংস করে দিচ্ছে।

আধুনিক কৃষি ও প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার : অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহার, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (GM) ফসলের প্রভাব, এবং ভুল প্রযুক্তির কারণে অনেক সময় কৃষিজমির উর্বরতা কমে যায়, যা ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

যাহার ফল ও প্রভাবের কারনে,কৃষি উৎপাদন কমে গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বৃক্ষ নিধনের ফলে জলবায়ুর ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা ভূমিধস, খরা, ও বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়। কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হলে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ ধরনের অপরাধের বিচার না হলে এটি সমাজে আরও বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে। অন্যের ফসল ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা একটি অপরাধ, এবং এর জন্য বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী শাস্তি : বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, 1860)-তে ফসল নষ্ট করার বিষয়ে কয়েকটি ধারা রয়েছে— ধারা ৪২৭ (সাধারণ ক্ষতি) – যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের সম্পত্তি বা ফসল নষ্ট করে এবং ক্ষতির পরিমাণ ৫০ টাকা বা তার বেশি হয়, তবে ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড হতে পারে। ধারা ৪৩০ (সেচ বা কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি) – যদি কেউ কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির উৎস বা কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি করে, তবে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড হতে পারে। ধারা ৪৩১ (গোচারণ বা রাস্তার মাধ্যমে ক্ষতি করা) – যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের জমিতে গবাদি পশু ছেড়ে দিয়ে ফসল নষ্ট করে, তবে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে।

বিশেষ পরিস্থিতিতে ফসল ধ্বংস করলে – যদি কেউ প্রতিহিংসার কারণে বা শত্রুতা করে ফসল পুড়িয়ে দেয় বা সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলে, তবে এটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

ইদানিং কালে দেশে লোভ-লালসা,  রাজনৈতিক অস্থিরতা , সামাজিক অবক্ষয় , ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং  প্রতিশোধ মূলক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিরপরাধ ফল ফসলাদি -বৃক্ষরাজি উপর মানুষের নির্দয় আচরণ ক্রমেই বেড়ে চলছে ! যা একটি দেশের জন্য ভয়ানক পরিণতির নিদর্শন প্রকাশ করে !  এই মানব সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে জরুরী আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার এখনই সময়। মানুষের লোভ, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে ফসল ও বৃক্ষরাজির ওপর নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করতে সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও কৃষি-সমৃদ্ধ দেশ নিশ্চিত করা যায়। এ বিষয় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।