"পোষা প্রাণিকে এডাপ্ট করুন, বিক্রি নয়"-আন্তর্জাতিক পোষা প্রাণি দিবস' ২০২৫-এ আমাদের সামাজিক দায়িত্ব

রোটারিয়ান ড মো হেমায়েতুল ইসলাম আরিফঃ
ভূমিকাঃ
প্রতি বছর ১১ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক পোষা প্রাণি দিবস (International Pet Day)। এই দিনটি বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রে "ন্যাশনাল পেট ডে" নামে পরিচিত, যেখানে পোষ্যদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। এই দিনের মূল উদ্দেশ্য হলো পোষ্যদের যত্ন নেওয়া, তাদের অধিকার রক্ষা করা এবং আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পোষা প্রাণি গ্রহণে মানুষকে উৎসাহিত করা। বর্তমানে এই দিনটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক পোষা প্রাণি দিবস হিসেবে পালিত হয়।

এই বিশেষ দিনটির সূচনা করেছিলেন কলিন পেজ (Colleen Paige), একজন প্রাণী কল্যাণকর্মী এবং পোষ্য ও পরিবার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তার এই উদ্যোগের মাধ্যমে সারা বিশ্বে পোষা প্রাণি প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং লক্ষাধিক অবহেলিত প্রাণী নতুন ঘর পেয়েছে। ২০২৫ সালের থিম হলো "পোষা প্রাণি এডাপ্ট করুন, বিক্রি নয়" (Adopt, Don’t Shop)। এটি শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন, যা পশু-পাখির অধিকার ও মানবিকতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়।

বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ অবহেলিত পোষা প্রাণি (কুকুর, বিড়াল) রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, যারা অপরিকল্পিত প্রজনন, দুর্ঘটনা ও রোগের শিকার হয়। এদের মধ্যে অনেকেই জুনোটিক রোগ (যেমন: রেবিস, স্ক্যাবিস, লেপ্টোস্পাইরোসিস) ছড়ায়, যা মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এই সমস্যা সমাধানে পোষা প্রাণি গ্রহণ (Adoption) একটি টেকসই ও নৈতিক সমাধান।

আন্তর্জাতিক পোষা প্রাণি দিবসের ইতিহাস
২০০৬ সালে কলিন পেজ প্রথম ন্যাশনাল পেট ডে পালনের ঘোষণা দেন। তার লক্ষ্য ছিল:
• পেট বা পোষ্যদের অবদান ও গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
• পোষ্যদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করতে উৎসাহিত করা।
• আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পোষ্য গ্রহণের মাধ্যমে একটি প্রাণীর জীবন বাঁচানো।

বাংলাদেশে স্ট্রিট অ্যানিম্যালের সংকট ও জুনোটিক রোগের ঝুঁকি
বাংলাদেশে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা লক্ষাধিক। এদের বেশিরভাগই অনাহার, দুর্ঘটনা ও রোগে ভোগে। এদের মাধ্যমে ছড়ায় এমন কিছু মারাত্মক রোগ:

1. রেবিস (Rabies) – কুকুরের কামড়ে এই মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ রোগ ছড়ায়। WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২,০০০+ মানুষ রেবিসে মারা যায়।
2. স্ক্যাবিস (Scabies) – চর্মরোগ যা পশু থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়।
3. লেপ্টোস্পাইরোসিস (Leptospirosis) – প্রাণীর মূত্রের মাধ্যমে ছড়ায়, যা কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করে।
4. টক্সোপ্লাজমোসিস (Toxoplasmosis) – বিড়ালের মাধ্যমে ছড়ানো পরজীবী, যা গর্ভবতী নারীদের জন্য বিপজ্জনক।
এই রোগগুলো রোধ করতে পোষ্য গ্রহণ ও টিকা দেওয়া জরুরি।

"পোষা প্রাণিকে এডাপ্ট করুন, বিক্রি নয়" – কেন এই প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ?

১. পেট/পোষা প্রাণি দোকান ও অপ্রীতিকর প্রজনন ব্যবসার অবসান
পোষ্য দোকান ও ব্রিডাররা শুধু লাভের জন্য প্রাণী বিক্রি করে, যেখানে:
• প্রাণীদের অমানবিকভাবে রাখা হয়।
• জিনগত ত্রুটিযুক্ত প্রাণী জন্মায় (যেমন: হিপ ডিসপ্লাসিয়া)।
• অতিরিক্ত প্রজননে অনেক প্রাণী পরিত্যক্ত হয়।
•এডপশন এই চক্র ভাঙতে সাহায্য করে।

২. স্ট্রিট অ্যানিম্যাল কন্ট্রোল ও রোগ নিয়ন্ত্রণ
যখন আমরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পোষ্য গ্রহণ করি:
• রাস্তার প্রাণীর সংখ্যা কমে।
• টিকা ও নিউটার/স্পে করে রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।
• সমাজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাড়ে।
৩. অর্থনৈতিক ও মানবিক সুবিধা
• সাশ্রয়ী: এডপশন ফি ব্রিডার থেকে কেনার চেয়ে কম।
• উদ্ধারকৃত প্রাণীর আনুগত্য: তারা নতুন পরিবারের প্রতি অসম্ভব কৃতজ্ঞ হয়।
• সামাজিক দায়িত্ব: আমরা একটি প্রাণীর জীবন বাঁচাই।

কিভাবে পোষা প্রাণি গ্রহণ করবেন?

ধাপ ১: স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন
বাংলাদেশের কিছু সংগঠন:
• Rajshahi University Student Welfare Association
• অ্যানিম্যাল হেল্প ফাউন্ডেশন (AHF)
• ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল রেসকিউ (WAR)
• Street animal welfare organization
• Bangladesh Animal Welfare Society- BAWS
• Animal Welfare Organization
• Aastha Animal Welfare Organisation
• Rajshahi Animal Welfare Society (RAWS)
• Rajshahi animal lovers society (Rals)
• Wild Life Management & Nature Conservation Division, Rajshahi

ধাপ ২: প্রাণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা
• টিকা (রেবিস, ডিসটেম্পার) নিশ্চিত করুন।
• নিউটার/স্পে করান।

ধাপ ৩: বাড়িতে মানানসই পরিবেশ তৈরি
• নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য ও খেলার ব্যবস্থা করুন।

ধাপ ৪: দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব নিন
• নিয়মিত ভেটেরিনারি চেকআপ।
• ভালোবাসা ও ধৈর্য্য রাখুন।

আন্তর্জাতিক পোষা প্রাণি দিবস ২০২৫-এ আমাদের করণীয়
১. সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন – #AdoptDontShop বাংলাদেশে ট্রেন্ড করানো।
২. স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী – খাবার, ওষুধ দান করুন।
৩. সেমিনার আয়োজন – স্কুল-কলেজে সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।
৪. একটি পোষা প্রাণি গ্রহণ করুন – আপনার বাড়িতে একটি উদ্ধারকৃত প্রাণীকে বাসা দিন।

সবেশেষে আবারো বলতে চাই "পোষা প্রাণি এডাপ্ট করুন, বিক্রি নয়" – এটি শুধু একটি স্লোগান নয়, একটি নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে স্ট্রিট অ্যানিম্যাল ও জুনোটিক রোগের সমস্যা সমাধানে পোষ্য গ্রহণ একটি টেকসই সমাধান। এই আন্তর্জাতিক পোষা প্রাণি দিবস ২০২৫-এ আসুন আমরা সবাই একটি করে প্রাণীর জীবন বদলে দিই।

"প্রাণীদের জন্য আপনার একটি সিদ্ধান্তই তাদের সমস্ত জীবন বদলে দিতে পারে।"

লেখক:
সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বি এল এস)