ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রাজশাহী-এর সদস্যগণের প্রত্যাশা"

রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ
আজীবন সদস্য, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রাজশাহী

ভূমিকা

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ দেশের অন্যতম একটি বেসরকারি, সেবামূলক, অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের হৃদরোগ সংক্রান্ত সচেতনতা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার লক্ষ্যে গঠিত। এর রাজশাহী শাখাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে উত্তরাঞ্চলের মানুষদের হৃদরোগ নিরাময়ে। ২৬ এপ্রিল ২০২৫ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০২৫-২০২৮ সালের জন্য ফাউন্ডেশনের কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে সদস্যদের প্রত্যাশা, দাবিদাওয়া, পরামর্শ ও স্বপ্ন নিয়ে একগুচ্ছ চিন্তা-ভাবনা ও বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো এই প্রবন্ধে।

ফাউন্ডেশনের গঠন ও লক্ষ্য

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রাজশাহীর মূল লক্ষ্য—
১. সাধারণ মানুষের মাঝে হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
২. স্বল্পমূল্যে হৃদরোগ সংক্রান্ত চিকিৎসা সেবা প্রদান।
৩. পেশাদার হৃদরোগ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
৪. হৃদরোগ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা।

এই লক্ষ্যের বাস্তবায়নে ফাউন্ডেশনের সদস্যদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যকর পরিচালনা কমিটি গঠন করা না গেলে এইসব লক্ষ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে পারে। তাই এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সদস্যদের প্রত্যাশা যথেষ্ট যৌক্তিক ও সময়োপযোগী।

১. চিকিৎসা সেবায় পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি

বর্তমান সময়ে হৃদরোগ চিকিৎসা একটি অত্যন্ত পেশাদার ও প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষেত্র। চিকিৎসা ব্যবস্থায় পেশাদারিত্ব না থাকলে রোগীদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনেক সদস্য মনে করেন—

  • চিকিৎসকদের সময়মতো উপস্থিতি ও নিয়মিত ফলোআপ নিশ্চিত করতে হবে।

  • চেম্বার বা ওয়ার্ডে সময়োপযোগী মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে।

  • রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে ভদ্রতা ও সম্মানজনক আচরণ আবশ্যক।

বিশেষ করে নার্স ও প্যারামেডিক কর্মীদের নিয়োগে এবং পরিচালনায় পেশাদার নিয়মনীতি থাকা জরুরি। অনেক অভিজ্ঞ কর্মী শুধুমাত্র অনির্দিষ্ট চুক্তিভিত্তিক চাকরির কারণে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যান। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ফাউন্ডেশনের একমাত্র উপায়— স্থায়ী বেতন কাঠামো চালু করা।

২. স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা: ফাউন্ডেশনের মূল আত্মা

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। এর মূল দর্শন—
"কম খরচে হৃদরোগ চিকিৎসা সবার জন্য নিশ্চিত করা।"

সদস্যদের একাংশ বলেন—

  • ফাউন্ডেশনের নির্ধারিত ফি অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি হাসপাতালের মতোই বেশি।

  • গরীব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য ‘সাবসিডাইজড’ চিকিৎসা সেবা চালু করা উচিত।

  • রোগীদের জন্য কম মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ECG, Echo, Angiogram ইত্যাদি) সুবিধা চালু করা জরুরি।

একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ নৈতিকভাবে সঠিক নয়। তাই সকল সদস্যের দাবি— "সেবা আগে, লাভ নয়।"

৩. ফাউন্ডেশনের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

আধুনিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন আধুনিক অবকাঠামো ও প্রযুক্তি। বর্তমান যুগে Cardiac ICU, Cath Lab, Portable ECG, EMR (Electronic Medical Record) ছাড়া উন্নত চিকিৎসা সম্ভব নয়। সদস্যদের মতামত—

  • রাজশাহীতে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘হার্ট হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

  • রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণাগার গড়ে তোলা হোক।

  • ডিজিটাল রিপোর্টিং ও রোগীর ফলোআপ সফটওয়্যার চালু করা হোক।

৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা

একটি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর। সদস্যগণের সুস্পষ্ট অভিমত—

  • বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব সদস্যদের সামনে প্রকাশ করতে হবে।

  • নিয়োগ, পদোন্নতি, ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়সহ সকল কার্যক্রম স্বচ্ছ হতে হবে।

  • ‘অডিট রিপোর্ট’ নিয়মিত সদস্যদের নিকট উপস্থাপন করতে হবে।

এছাড়াও অনেক সদস্য মনে করেন, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত গোষ্ঠী বা চক্র যেন ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব দীর্ঘ সময় দখল করে রাখতে না পারে, তার জন্যও নির্বাচন ব্যবস্থা আরো গণতান্ত্রিক হতে হবে।

৫. নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ

এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে ভোটগ্রহণ পদ্ধতি, প্রার্থীদের পরিচিতি, এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরার যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সদস্যদের দাবি—

  • সকল প্রার্থী যেন তাদের নিজ নিজ কর্ম বিবরণ ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রকাশ করেন।

  • একক প্লাটফর্মে প্রার্থীদের উন্মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব আয়োজন করা উচিত।

  • নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।

এইভাবে নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য, যার মাধ্যমে প্রকৃত সেবাপরায়ণ নেতৃত্ব উঠে আসবে।

৬. চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন

হার্ট ফাউন্ডেশন রাজশাহীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর চিকিৎসক ও মেডিকেল স্টাফদের দক্ষতার ওপর। সদস্যগণ চাইছেন—

  • স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে চিকিৎসকদের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে।

  • গবেষণার জন্য অনুদান ও ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

  • ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ‘Academic Cell’ গড়ে তুলে CPD (Continuing Professional Development) চালু করা উচিত।

৭. দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী রোগীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ

অনেক সদস্য মনে করেন, ফাউন্ডেশন যেহেতু জনসেবায় নিয়োজিত, তাই ‘হার্ট কেয়ার ফর পুওর’ কর্মসূচি চালু করা উচিত। এই কর্মসূচির আওতায়—

  • দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

  • CSR (Corporate Social Responsibility) প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেয়া যেতে পারে।

  • সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

৮. সেবার গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য নিরীক্ষা দল গঠন

সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন—

  • রোগীদের মতামত সংগ্রহ করে প্রতিমাসে ‘Patient Satisfaction Index’ তৈরি করা যেতে পারে।

  • নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ‘Quality Control Team’ হাসপাতাল পরিদর্শন করে সেবার মান যাচাই করবে।

  • স্টাফদের আচরণ, সময়ানুবর্তিতা ও দক্ষতা পর্যালোচনার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে।

৯. যুব সমাজ ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা

  • কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।

  • “Young Heart Volunteer” প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুব সমাজকে ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।

  • স্বাস্থ্যবিষয়ক কুইজ, পোস্টার প্রতিযোগিতা, ওয়ার্কশপ আয়োজন করা যেতে পারে স্কুল-কলেজে।

১০. ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য সুদৃঢ় পরিকল্পনা

প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলা। এজন্য সদস্যদের দাবি—

  • পরবর্তী নেতাদের জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করা উচিত।

  • নির্বাহী পরিষদে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

  • প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদী ভিশন ও মিশন হালনাগাদ করতে হবে।

উপসংহার

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রাজশাহী একটি জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান। এর গঠন, কাঠামো, সেবা, এবং নেতৃত্ব— সব কিছুই হওয়া উচিত সেবার মাপকাঠিতে। আগামী ২৬ এপ্রিল ২০২৫-এর নির্বাচন এই প্রতিষ্ঠানকে নতুন দিগন্তে পৌঁছানোর এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। সঠিক নেতৃত্ব বাছাইয়ের মাধ্যমে সদস্যদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেই রাজশাহীবাসী লাভ করবে একটি আধুনিক, সাশ্রয়ী, পেশাদার, ও জনবান্ধব হৃদরোগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান।
ভবিষ্যতের নেতৃত্বের প্রতি আবেদন:

"নেতৃত্ব মানেই শুধু পদ নয়, বরং দায়িত্ব। দায়িত্ব মানেই জনসেবায় আত্মনিয়োগ। ফাউন্ডেশনের প্রতিটি সদস্য, কর্মচারী এবং রোগীর প্রতি দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা নিয়েই যেন গড়ে ওঠে আগামী দিনের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রাজশাহী।"