শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষকস্বপ্ন ও আজকের বাস্তবতা

কৃষিবিদ মোঃ শাহাদত হোসেন: আজ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬২ সালের আজকের দিনে (২৭ এপ্রিল) তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রথিতযশা এই বাঙালি রাজনীতিক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইতিহাসের পাতায় শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, বরং ছিলেন বাংলার কৃষকসমাজের আস্থাভাজন অভিভাবক। একজন মুসলিম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি কৃষক, মজুর, প্রজাদের জন্য রাজনীতিকে আশীর্বাদরূপে ব্যবহার করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন এক সমাজ বিনির্মাণ করা, যেখানে কৃষক কেবল একটি উৎপাদনশীল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হেবে না, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের মর্যাদাপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এ লক্ষ্যে তিনি ১৯৩৬ সালে কৃষক প্রজা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার প্রথা, খাজনা ও সুদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে তিনি নিরলস কাজ করেছেন। তাঁর আদর্শ ছিল, কৃষকের উন্নয়ন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন কৃষকের মুখে হাসি ফিরলেই সাধিত হবে প্রকৃত উন্নয়ন। শেরেবাংলা বিশ্বাস করতেন গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়।

তিনি রাজনৈতিক ভাষণে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ও নীতিগত অবস্থানে সবসময় কৃষকের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় অবদানগুলোর একটি হচ্ছে প্রজাস্বত্ব আইন, যা কৃষকদের ভূমির অধিকার সুরক্ষিত করেছিল। ১৯৩০-এর দশকে এই আইনই ছিল উপমহাদেশের কৃষকদের জন্য এক যুগান্তকারী অর্জন। ব্রিটিশ শাসনের কঠোর ভূমি রাজস্ব নীতির বিপরীতে এই আইন কৃষকদের আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা খাদ্য উৎপাদনে বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখিয়েছি। ধান, গম, সবজি, মাছ—সবখানেই বেড়েছে উৎপাদন। আমরা খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই উন্নয়নের প্রকৃত কারিগর যে কৃষক, তাঁদের জীবনযাত্রার মান কি সত্যিই বেড়েছে? এ উন্নয়নের সুফল তাঁরা কতটুকু পাচ্ছেন?

বাস্তবতায় কৃষকের স্থান কোথায়?
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কৃষক এখনো দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রেণি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশ কৃষিখাতে নিয়োজিত থাকলেও জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। এবং দুঃখজনকভাবে প্রতি বছর জিডিপিতে কৃষির অবদান কমছে। অর্থাৎ একদিকে তারা খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান নিয়ামক, অন্যদিকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় তারা অবহেলিত। অন্যান্য খাতের উন্নয়নে আমরা যতোটা গুরুত্ব দিচ্ছি কৃষির উন্নয়নে ততোটা গুরুত্ব দিচ্ছি কিনা এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ কৃষক এখনো ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের ঘাম ঝরানো ফসলের লাভের বড় অংশ হাতিয়ে নেয়। বগুড়ায় যখন এক কেজি বেগুনের দাম ২০ টাকা তাখন সেই বেগুন ঢাকায় আমাদেরকে কিনতে হয় ১০০ টাকায়। শুধু হাত বদলের মাধ্যমে এক মধ্যস্বত্বভোগী প্রতি কেজিতে ৮০ টাকা নিয়ে যাচ্ছে। আর ৪ থেকে ৫ মাস ঘাম ঝরিয়ে কৃষক পাচ্ছে মাত্র ২০ টাকা। ঋণের বোঝা এখন বেশিরভাগ কৃষকের নিত্যসঙ্গী। ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা তাড়া করে বেড়ায় প্রতিটি কৃষককে। প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা, উপযুক্ত সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থার অভাব, সবকিছু মিলে কৃষকের জীবন এখনো অনিশ্চয়তায় ভরা।

কৃষকের জন্য নেই শক্তিশালী সংগঠন, নেই সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার ঘোষিত ন্যূনতম দাম কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, উৎপাদন ব্যয় প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, কৃষিশ্রমিকের মজুরি সবই বেড়েছে। ফলে, বিক্রির সময় কৃষককে ঠকতেই হয়। কৃষক ফসলের দাম ঠিকমতো না পেলে প্রতিবাদ করার সুযোগটুকুও পায় না। তাঁদের কথা বলার জায়গা নেই। গণমাধ্যমের সাথে নিজে থেকে যোগাযোগ করে সমস্যার কথা জানানোর পথটাও তাঁরা চিনে না। যতক্ষণ না কোন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি নিজে থেকে তাঁদের কাছে যায় ততক্ষণ তাঁদের কথা কেউ শোনে না। বেশিরভাগই বোঝে না সোশ্যাল মিডিয়া কি? তাঁদের আওয়াজ তাই বেশিদূর পৌঁছায় না।

কৃষি উন্নয়নে সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসেছে ‘সবুজ বিপ্লব’। কৃষিবিদদের নিরলস সাধনায় আবিষ্কৃত হয়েছে উচ্চ ফলনশীল ধান ও সবজির জাত। মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামার বিস্তৃত হয়েছে কয়েক গুণ। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারও বেড়েছে। তবে এ উন্নয়নের বেশিরভাগ কিছু ধনী কৃষক ও উদ্যোক্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রান্তিক কৃষকের কাছে এখনো অনেক প্রযুক্তি পৌঁছায়নি।

একইসঙ্গে, কৃষির আধুনিকায়ন বলতে আমরা অনেক সময় শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিকে বুঝি। কিন্তু শেরেবাংলা ফজলুল হকের দর্শন ছিল কৃষিখাতে মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, যেখানে কৃষক শুধু ফসল উৎপাদনকারী নয়, একজন সম্মানিত, মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক। তিনি বারবার বলেছেন, কৃষকের উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

শেরেবাংলার স্বপ্ন ও বর্তমান বাংলাদেশ
শেরেবাংলা চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে কৃষক তাঁর জমির পূর্ণ মালিক হবে, উৎপাদন ব্যবস্থা থাকবে তাঁরই নিয়ন্ত্রণে, আর রাষ্ট্র তাঁকে সহায়তা করবে উপযুক্ত মূল্যে ফসল বিক্রির মাধ্যমে। বর্তমান বাংলাদেশে কৃষির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পাশাপাশি রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ।

অগ্রগতির দিক: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নিঃসন্দেহে কৃষক ও কৃষিবিদদের একটি বড় অর্জন। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের নিরলস পরিশ্রমে কৃষি গবেষণায় সাধিত হয়েছে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি। উচ্চ ফলনশীল, ভিটামিন-এ ও জিংক সমৃদ্ধ, খরা ও বন্যা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন যেমন ধানের উৎপাদন কয়েক গুণ করে দিয়েছে। তেমনি টমাটিলো, টমালু, বাহারি রংয়ের চেরি টমেটো, বেগুন, লাউ ইত্যাদির জাত উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে দেশজ সবজির জগতে এসছে বৈচিত্র্য। সরিষা, পেরিলা, কিনোয়ার নতুন জাত তৈল বীজ উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা যোগ করেছে। মাছ গবেষণাতেও বিগত কয়েক বছরে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দারুন সাফল্য লাভ করেছে। নতুন নতুন মাছ সনাক্ত করার পাশাপাশি তারা মাছ সংরক্ষনের কয়েকটি কৌশল আবিষ্কার করেছে। তার মধ্যে মাছের কৌটাজাতকরণ ও মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টায় মাছ শুকিয়ে শুটকিতে পরিণত করার যন্ত্র ব্যবহারে কৃষক ও উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে সাফল্য লাভ করেছে।

শুধু ফসলের জাত উদ্ভাবণ নয়, বেশকিছু কৃষিপণ্য রপ্তানির দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে শস্য, ফুল, ফল, মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি। চলতি বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শুধু চীন ১ লাখ ২০ হাজার টন আম নিবে বলে বিভিন্ন গনমাধ্যম মারফত নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এছড়াও কৃষকদের কৃষি কার্ডের প্রদান করার মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের হাতে নানা কৃষি উপকরণ ও সহযোগিতা পৌঁছানো হচ্ছে। তবে প্রকৃতপক্ষে যেসব কৃষক এ সুবধা পাওয়ার যোগ্য তারা পাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়াও কৃষক পাচ্ছে সহজ শর্তে কৃষিঋণ ও ভর্তুকি। সহজ শর্তে ঋণ প্রদান যথেষ্ট নয়, সুদমুক্ত ঋণ কৃষকদের প্রদান করতে হবে।

এতো সাফল্যের পরও কিছু ব্যর্থতার ভারে নুইয়ে আছে আমাদের কৃষিখাত। এখনও ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায়নি। ন্যায্য দাম না পেয়ে প্রতি বছরই কিছু কৃষক বাঁধাকপি ক্ষেতেই চাষ দিয়ে দেয়। কিছু টমেটো চাষীও একই কারণে ফসল রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। কৃষি উপকরণের নিয়ন্ত্রণহীন দামে আমরা এখনও লাগাম টানতে পারিনি। মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের দৌরাত্ম্য এবার কিছুটা কমলেও এর স্থায়ী সমাধান আনতে পারিনি। এবারের রমযানে, ঈদুল ফিতরে কৃষি পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে পেলেও আগামীতে তা পাব কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানির ফলে ক্ষতির আশঙ্কা কমাতে শস্য বীমার পরিধি বৃদ্ধি করে ছোট-বড় প্রত্যেক কৃষককে এর আওতায় আনতে হবে।

কৃষকের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত ও নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে না পারলে কৃষি উন্নয়নের প্রকৃত স্বাদ কৃষক আস্বাদন করতে পারবে না। সমাজে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। না আছে সমাজ সংস্কারে তাদের মূল্যায়ন, না আছে কোন সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব। কৃষকরা এখনও সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণি।

কৃষিবিদদের ভূমিকা
শুধু নীতিনির্ধারক নয়, দেশের কৃষিবিদদেরও শেরেবাংলা কে ফজলুল হকের আদর্শ অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা যেন বাস্তব জীবনের প্রয়োজন মেটায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি গবেষণার সাথে বাণিজ্যের দৃঢ় সংযোগ স্থাপন করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারদের নিয়মিত মাঠভিত্তিক কাজ, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির হস্তান্তরের দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে কৃষকের থেকে সরাসরি কৃষি পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে যে এলাকায় যে ফসলের উৎপাদন ভাল হয় সে ফসলের সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে। সভা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষির প্রতি তরুণদের আগ্রহ তৈরি করতে হবে। কৃষিকে লাভজনক করে তোলার জন্য তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে হবে।

একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মাথায় রেখে উপকূলীয় ও খরাপ্রবণ এলাকার জন্য ফসলের আরও নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবনের দিকে নজর দিতে হবে। টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার এখন সময়ের দাবি। বর্তমানের চাহিদা মেটাতে গিয়ে যেন আমরা আগামীর পৃথিবীকে কৃষি উৎপাদনের অযোগ্য করে না তুলি সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

শেষ কথা
আজকের দিনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে স্মরণ করার উত্তম উপায় হলো তাঁর আদর্শকে এ সমাজ ও রাষ্ট্রকে পুনরায় মনে করিয়ে দেওয়া, তা বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করা। তাঁর স্বপ্নকে পূরণ করতে হলে কৃষিকে রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনায় এনে কৃষকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজর দিতে হবে। কৃষককে শুধু উৎপাদনের যন্ত্র না ভেবে সমাজের একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে। “কৃষক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে”- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের এ বাণীকে রাষ্ট্র পরিকল্পনায় মূল বিবেচ্য করে তুলতে হবে।