শব্দ সচেতনতা: এক নীরব বিপদের মুখোমুখি বাংলাদেশ

আবুল বাশার মিরাজ: প্রতিবছর এপ্রিলের শেষ বুধবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় 'আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস'। এ দিবসটি আমাদের কানে কম শোনা সেই ভয়ঙ্কর দূষণ, ‘শব্দদূষণ’ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, শব্দদূষণের ভয়াবহতায় বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এই নিরব দূষণ আমাদের স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ভয়ানক প্রভাব ফেলছে।

শব্দদূষণ বলতে আমরা বুঝি এমন অবাঞ্ছিত শব্দ, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, দিনের বেলায় ৫৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দস্বল্পতা ক্ষতিকর হতে পারে, আর রাতে ৪০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শব্দের মাত্রা ৯০ থেকে ১১৫ ডেসিবেল পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

২০২৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক যৌথ জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। মতিঝিল, ফার্মগেট, মিরপুর, নিউ মার্কেট এবং গুলিস্তানের মতো এলাকাগুলোতে দিনে গড় শব্দের মাত্রা ৯০ ডেসিবেলের ওপরে। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও বগুড়ার মতো শিল্প ও বাণিজ্যিক নগরীতেও শব্দদূষণের ভয়াবহতা বাড়ছে। বিশেষ করে যানবাহনের হর্ন, নির্মাণ কাজ, লাউডস্পিকার ও অব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা শহুরে পরিবেশ এর মূল কারণ।

শব্দদূষণের সরাসরি প্রভাব পড়ে মানুষের শ্রবণশক্তির ওপর। উচ্চমাত্রার শব্দে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে বধিরতা দেখা দিতে পারে। শুধু তাই নয়, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ, অনিদ্রা, মানসিক উদ্বেগ, শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা, এমনকি গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাতের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

২০২১ সালে ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির একটি গবেষণায় বলা হয়, প্রতি বছর ইউরোপে অন্তত ১২ হাজার মানুষ শব্দদূষণজনিত কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করে। যদিও বাংলাদেশে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই, তবে একই ধরনের ঝুঁকি এখানে বহুগুণে বেশি।

শব্দদূষণের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও কার্যকর প্রয়োগ এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। ২০০৬ সালের ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা’ অনুসারে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও নীরব এলাকাগুলোতে শব্দের মাত্রা নির্ধারিত থাকলেও তা বাস্তবে মানা হয় না। জরিমানা কিংবা অভিযান খুবই সীমিত, আবার জনসচেতনতা না থাকায় মানুষও সচেতনভাবে হর্ন বাজানো কিংবা লাউডস্পিকার ব্যবহারে বিরত থাকছে না।

এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের প্রথম প্রয়োজন জনসচেতনতা। শব্দদূষণবিরোধী ক্যাম্পেইন, স্কুল-কলেজে সেমিনার ও লিফলেট বিতরণের মতো কর্মসূচি দেশজুড়ে বিস্তৃত করা জরুরি। পাশাপাশি, নগর পরিকল্পনায় ‘শব্দ-বান্ধব’ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানকার পরিবেশ রক্ষা করা প্রয়োজন। যানবাহনে অপ্রয়োজনীয় হর্ন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে আরও সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

শেষকথা, শব্দদূষণ কোনো কল্পিত বিষয় নয়, এটি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এক বিপজ্জনক দূষণ, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে। আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস আমাদের সুযোগ করে দেয় নিজেকে প্রশ্ন করার, আমার ব্যবহারে অন্য কেউ বিরক্ত হচ্ছে কি না? আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে একটি শান্ত, সুস্থ ও সহনীয় শব্দবান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।

লেখক: পরিবেশবিদ