রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ
ভূমিকা
প্রতি বছর ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালিত হয় এই জিনগত রক্তজনিত রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিৎসার সুযোগ প্রসার ও আক্রান্তদের প্রতি সমর্থন জানানোর লক্ষ্যে। ১৯৯৪ সালে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন (টিআইএফ) এই দিবসের সূচনা করে, যা টিআইএফ প্রতিষ্ঠাতার সন্তান জর্জ এঙ্গেল জোসের স্মৃতিকে সম্মান করে যিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬,০০০ থেকে ১৩,০০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যা একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট। এই দিবসের প্রতিপাদ্য ২০২৫ সালে "Empowering Lives, Embracing Progress: Access to Quality Care for Every Patient"—যা সকল রোগীর জন্য সমান চিকিৎসা সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
থ্যালাসেমিয়া কী?
থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রক্তের রোগ, যেখানে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন ব্যাহত হয়। হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্তকণিকার মাধ্যমে দেহে অক্সিজেন পরিবহন করে। এই ঘাটতির ফলে রক্তশূন্যতা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়।
প্রকারভেদ:
- আলফা থ্যালাসেমিয়া: আলফা-গ্লোবিন জিনের মিউটেশনের কারণে হয়।
- বিটা থ্যালাসেমিয়া: বিটা-গ্লোবিন জিনের ত্রুটির ফলে সৃষ্টি হয়।
লক্ষণ:
- অবসাদ ও দুর্বলতা
- ত্বক ফ্যাকাশে বা হলুদ হয়ে যাওয়া
- শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত (বিশেষত শিশুদের মধ্যে)
- প্লীহা বা যকৃতের আকার বৃদ্ধি
প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
- ১. থ্যালাসেমিয়া কি ছোঁয়াচে?
না, এটি জিনগত রোগ; সংস্পর্শে ছড়ায় না। - ২. বাহকদের কি চিকিৎসা প্রয়োজন?
বাহকদের সাধারণত চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, তবে তাদের সন্তানদের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। - ৩. থ্যালাসেমিয়া নিরাময় সম্ভব?
হ্যাঁ, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে, তবে এটি জটিল ও ব্যয়বহুল। - ৪. বাংলাদেশে কোথায় স্ক্রিনিং করা যায়?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বারডেম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বিনামূল্যে স্ক্রিনিং সুবিধা রয়েছে।
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার চিত্র
বাংলাদেশ "থ্যালাসেমিয়া বেল্ট"-এর অংশ, যেখানে জনসংখ্যার ১০-১২% (প্রায় ১.৭ কোটি) এই রোগের বাহক। প্রতি বছর ১৩,০০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়, যাদের অধিকাংশই নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন ও চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল। তবে সচেতনতা ও স্ক্রিনিংয়ের অভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোগ ধরা পড়ে দেরিতে।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
চিকিৎসা পদ্ধতি:
- নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন: তীব্র থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের জন্য আবশ্যক।
- আয়রন চিলেশন থেরাপি: রক্ত সঞ্চালনের ফলে দেহে জমা অতিরিক্ত আয়রন দূর করতে।
- বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট: একমাত্র সম্ভাব্য নিরাময় পদ্ধতি, তবে দাতার উপস্থিতি ও ব্যয় সীমিত করে তুলেছে।
- জিন থেরাপি (পরীক্ষামূলক): আশার আলো দেখাচ্ছে, তবে এখনও গবেষণাধীন।
প্রতিরোধ:
- বাহকে-বাহকে বিবাহ প্রতিরোধঃ রক্ত স্ক্রিনিং করে বাহক সনাক্ত করন এবং বাহকে-বাহকে বিবাহ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
- প্রি-ম্যারিটাল স্ক্রিনিং: বাহক শনাক্ত করে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া।
- প্রিন্যাটাল ডায়াগনোসিস: গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা।
- জেনেটিক কাউন্সেলিং: ঝুঁকিপূর্ণ দম্পতিদের জন্য পরামর্শ।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের চ্যালেঞ্জ
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: চিকিৎসা ব্যয় (প্রতি বছর ২-৫ লাখ টাকা) মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের পরিবারের জন্য অসম্ভব।
- শারীরিক ও মানসিক কষ্ট: নিয়মিত হাসপাতাল ভিজিট, আয়রন ওভারলোডজনিত অঙ্গ ক্ষয়।
- সামাজিক কুসংস্কার: রোগ নিয়ে বৈষম্য ও বিয়েতে বাধা।
বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসের গুরুত্ব
এই দিবস সচেতনতা বৃদ্ধি, স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম জোরদার ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে:
- স্লোগান ২০২৫: "Empowering Lives, Embracing Progress: Access to Quality Care for Every Patient"
- লক্ষ্য:
১. সকলের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
২. স্কুল-কলেজে স্ক্রিনিং ক্যাম্প আয়োজন।
৩. সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে জিন পরীক্ষার সুবিধা প্রসার।
আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় উদ্যোগ:
থ্যালাসেমিয়া মুক্ত প্রজন্ম গঠনে এক দুরন্ত অঙ্গীকার — একটি মানবিক আবেদন
একটি বিন্দু রক্ত, একটি বার্তা, একটি সহানুভূতির হাত—
বাঁচাতে পারে একটি জীবন, বদলে দিতে পারে একটি ভবিষ্যৎ।
রোটারি ক্লাব রাজশাহী সেন্ট্রাল-এর পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে এক মানবিক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রাণের স্পন্দনে ভরা এক আন্দোলন— "থ্যালাসেমিয়া মুক্ত প্রজন্ম গঠনে একটি প্রতিশ্রুতি, একটি আন্দোলন"। ক্লাবের আইপিপি রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ এবং সিপি হাসিবুল হাসান-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রাজশাহীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে এই সামাজিক জাগরণ।
২০২৩ সালে, পিপি রোটারিয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন (রোটারি ক্লাব যশোর ইস্ট)-এর সহযোগিতায় ভারত থেকে রোটারি জেলা ৩২৯১-এর ২০২৬-২৭ সালের গভর্নর ডা. রামেন্দ্র হোম চৌধুরী-কে আমন্ত্রণ জানিয়ে গৃহীত এই কর্মসূচি এখন বহুমাত্রিক মানবিক উদ্যোগে রূপ নিয়েছে।
এই উদ্যোগকে সফল করতে একাত্ম হয়েছে রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও তরুণদের দল:
ফায়ার এন্ড রেসকিউ ভলানটিয়ারস, ইনসেন রাইডারজেড (IRZ), ছোট স্বপ্ন, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, ভলানটিয়ার ফর বাংলাদেশ, CYB, আরএমপি স্টুডেন্ট কমিউনিটি পুলিসিং, আমার বাংলা তরুণসংঘ, ভাইব্রান্ট ভিশনারি নেটওয়ার্ক, দ্য স্মাইলিং ফাউন্ডেশন, স্বচ্ছলতা এসোসিয়েশন, রেড ক্রিসেন্ট, সুর্যকিরণ সমাজ কল্যাণ সংস্থা, রাজশাহী মানব কল্যাণ টিম, রাজশাহী ক্যান্সার হাসপাতাল সহ আরো অনেক সংগঠন।
🔹 সচেতনতা ক্যাম্প, লিফলেট বিতরণ ও বাহক স্ক্রিনিং:
প্রতিনিয়ত আয়োজনের চেষ্ঠা করা হচ্ছে ক্যাম্প ও বিনামূল্যে বাহক স্ক্রিনিং, যেন সাধারণ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার মতো নীরব ঘাতক সম্পর্কে সচেতন হয় এবং আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে।
🔹 রক্তদান উৎসব:
রক্তদানকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিমাসে আয়োজনের চেষ্ঠার সামাজিক সংগঠন খোজা হচ্ছে, যেটি হতে পারে সক্রিয় এবং মানবিক রক্তদাতা নেটওয়ার্ক—যা হতে পারে কারো জীবনের শেষ আলো।
🔹 ২০২৫ সালের সেমিনার:
জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনার “থ্যালাসেমিয়া মুক্ত প্রজন্ম গঠনে আমাদের ভূমিকা” নতুন করে আমাদের অঙ্গীকারকে জাগ্রত করবে— জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রক্তদানে উৎসাহ এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো।
🔹 তরুণদের সম্পৃক্ততা:
রোটার্যাক্টর মো. জুলফিকার-এর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে থ্যালাসেমিয়া অ্যাম্বাসেডর টিম, যারা শহর থেকে গ্রাম—সবখানে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সচেতনতায় দীপ্ত বার্তা।
আমরা আহ্বান জানাই—
👉 সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তরুণ সংগঠক, সামাজিক সংগঠন ও মানবিক হৃদয়ের নাগরিকদের—
এই আন্দোলনের সহযাত্রী হোন, পাশে দাঁড়ান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু ও পরিবারগুলোর।
কারণ,
এই কর্মসূচি কেবল একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়—
এটি একটি জাতিকে সুস্থ, সচেতন ও করুণাময় ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেওয়ার এক দুরন্ত প্রতিশ্রুতি।
সচেতনতাই মুক্তির পথ
আপনিও অংশ নিন:
- রক্ত দিন: একটি রক্তদান একটি জীবন বাঁচাতে পারে।
- জানুন ও জানান: থ্যালাসেমিয়া বাহক টেস্টের গুরুত্ব প্রচার করুন।
- অর্থ সাহায্য: থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে অনুদান।
মনে রাখুন: একটি রক্তপরীক্ষাই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে থ্যালাসেমিয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখতে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি ও আইপিপি, রোটারি ক্লাব রাজশাহী সেন্ট্রাল