পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত ম্যানগ্রোভ চিংড়ী চাষ (আইএমএস) একটি উপযুক্ত পদ্ধতি

ড. এ. এম. সাহাবউদ্দিন:
ভূমিকাঃ চিংড়ী চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের এক অন্যতম খাত। বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চল বাগদা চিংড়ী চাষের জন্য উপযুক্ত স্থান। দেশের দক্ষিনাঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়ন উজাড় করার ফলে চিংড়ীর উৎপাদন কমার পাশাপাশি পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে পরিবেশ রক্ষা করে সমন্বিত ম্যানগ্রোভ চিংড়ী চাষ (আইএমএস) পদ্ধতি হল ম্যানগ্রোভ রক্ষা করে চিংড়ী উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এই পদ্ধতিটি এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং ভারত সহ অনেক দেশে টেকসই চিংড়ী চাষ পদ্ধতি হিসেবে অনুশীলন করছে। আইএমএস পদ্ধতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্র্ণ সহায়ক ম্যানগ্রোভ গাছ যেমন কেওড়া, কাকড়া, বাইন ইত্যাদি সংরক্ষন করা যায় সাথে সাথে পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্য এই মডেলটিকে সর্বোত্তম অনুশীলন হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

আইএমএস কি? এটি একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব সমন্বিত চিংড়ি চাষ পদ্ধতি । এ সমন্বিত জৈব চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ীর চাষের সাথে নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ সংযোজনের মাধ্যমে চাষের প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। ফলে এই চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলজ এবং বনজ পরিবেশের উপর ম্যানগ্রোভের অন্যান্য ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করা যায়।

আইএমএস পদ্ধতির সুবিধাঃ আইএমএস পদ্ধতিতে চিংড়ী চাষের সাথে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয় ঘটে ফলে-
১. বাহিরে থেকে পুষ্টি উপাদানের যোগান কম লাগে।
২. পরিবেশের উপর চিংড়ী চাষের নেতিবাচক প্রভাব কম পড়ে।
৩. চাষের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৪. রাসায়নিক পণ্যের ব্যবহার কমায়।
৫. কম বর্জ্য উৎপাদন করে।
৬. পুষ্টির পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করে।
৭. ম্যানগ্রোভের পাতা পানিতে জৈব কার্বন সরবরাহ করে যা প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরিতে সহায়তা করে।
৮. ম্যানগ্রোভের শ্বাস মূল ও পাতা মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
৯. শ^াসমূলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খাদ্যকণা (পেরিফাইটন) লেগে থাকে যা চিংড়ী খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
১০. ম্যানগ্রোভ গাছ যেমন কেওড়া গাছের পাতার নির্ব্জাস চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং প্রতিক‚ল পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।

আইএমএস চাষ পদ্ধতিঃ
১. স্থান নির্বাচনঃ আইএমএস পদ্ধতিতে চিংড়ী চাষের জন্য এমন ঘের নির্বাচন করতে হবে যেখানে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানো যায় এবং পানি সরবরাহের মাধ্যমে ঘেরের পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২. পাড় মেরামত, নালা খনন ও তলার কাদা অপসারণঃ আইএমএস পদ্ধতিতে চিংড়ী চাষের জন্য প্রতিটি ঘের সম্পুর্ণ শুকিয়ে মেরামত করতে হবে। ঘেরের চার পাশর্^ উচু করা প্রয়োজন যেন ঘেরে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পানি ধরে রাখা যায় এবং উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। তাই প্রত্যেকটি ঘেরের চতুরপার্শ্ব শক্ত মাটি দিয়ে উচু করতে হবে। প্রয়োজনে পাড়ের ভাঙ্গন রোধ করার জন্য পাড়ে জিওমেমব্রেন দিয়ে মাটি ভরাট করা যেতে পারে। ঘেরের ভিতরে চিংড়ী চলাচল ও আশ্রয়ের জন্য লম্বালম্বি নালা খনন করা হয় এবং খননকৃত মাটি দিয়ে গাছ রোপনের জন্য মাঝ বরাবর উচু ঢিবি তৈরি করা হয়। তাছাড়া চিংড়ীর সংক্রামক রোগের হার হ্রাস করার জন্য ঘেরের তলার অতিরিক্ত কাদা অপসারণ করতে হবে।
৩. ম্যানগ্রোভ গাছের প্রজাতি নির্বাচনঃ আইএমএস পদ্ধতিতে চিংড়ী চাষের জন্য আমাদের দেশের কেওড়া, বাইন ও কাকড়া কার্যকরী। তবে কেওড়া গাছের ঔষধিগুণ থাকায় এ গাছ ব্যবহার করা সর্বোত্তম।
৪. গাছ রোপন ও পরিচর্যাঃ বর্ষা মৌসুমে গাছ লাগাতে হবে। গাছ ঘেরের পাড়ের ঢালে এবং ঘেরের মাঝ বরাবার উচুঁ ঢিবিতে এক সারি করে লাগানো যেতে পারে। দেখা গেছে যে, মোট ঘেরের ৫-১০% জায়গায় ম্যানগ্রোভ গাছ রোপন করলে চিংড়ীর উৎপাদন ভাল হয়। প্রতি চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ২ মিটার। গাছের গোড়ার মাটি শক্ত হয়ে গেলে নিড়ানী দিয়ে তা আলগা করে দিতে হবে। গাছ বড় হলে নিচের দিকে ঝুঁকে যাওয়া ডালপালা কেটে দিতে হবে। গাছ গুলো সর্বোচ্চ ১০ মিটার পর্যন্ত বড় রাখা যেতে পারে। মাঝে মাঝে গাছের ডালপালা ছাটাই করে দিতে হবে।
৫. জৈব-নিরাপত্তা ও ম্যানগ্রোভ গাছ রক্ষাঃ চিংড়ীর রোগ সংক্রমনের ঝুকি কমাতে ও গবাদি পশুর হাত থেকে ম্যানগ্রোভ গাছ রক্ষা করার জন্য, প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি ঘেরের চার পাশর্^ জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
৬. পানি সরবরাহ ও নিস্কাশন ব্যবস্থাঃ পানি সরাবরাহ ও নিস্কাশনের জন্য পিভিসি পাইপ দিয়ে ঘেরে ইনলেট ও আউটলেট তৈরি করা হয়। ঘেরে কমপক্ষে তিন (০৩) ফুট ও নালায় ছয় (০৬) ফুট পরিমান পানি রাখতে হবে এবং বাহির থেকে ঘেরে লবণ পানি অবশ্যই ফিল্টার করে প্রবেশ করাতে হবে। প্রতিটি ঘেরে নির্দিষ্ট উচ্চতার পানি ধরে রাখার জন্য লেভেল পাইপ ব্যবহার করা যেতে পারে।

৭. পানি জীবানুমুক্ত করণঃ প্রবেশকৃত লবন পানি জীবানুমুক্ত করার জন্য ক্লোরিন ও চুন প্রয়োগ করতে হবে। ক্লোরিন ৩-৫ পিপিটি হারে ব্যবহার করা যেতে পারে। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধকারক একবার প্রয়োগ করা করার পর পানি কমে গেলে পুনঃরায় পানি বিশুদ্ধ করনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো যেতে পারে।
৮. প্রি-বায়োটিক তৈরি ও প্রয়োগঃ উপযুক্ত লবণাক্ততা পরীক্ষা করে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য উপরের চিত্র অনুযায়ী প্রি-বায়োটিক তৈরি করতে হবে এবং তা ১০ শতক ঘেরে প্রয়োগ করতে হবে।
৯. পিএল মজুদঃ ঘের প্রস্তুতির পর পানির গুনাগুন পরীক্ষা করে ও ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি যথাযথ হবার পর এসপিএফ (Specific Pathogen Free) বাগদার পোনা নিম্রোক্ত হারে ২ টি ধাপে মজুদ করতে হবে-

১০. খাদ্য প্রয়োগঃ ঘেরের চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব ও ওজনের উপর ভিত্তি করে প্রাথমিক ভাবে পাউডার খাবার ও পরবর্তীতে ডুবন্ত পিলেট খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্য দিনে ২ বার (সকাল ও সন্ধ্যা) প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্যের সাথে নিম্ন চিত্র অনুযায়ী তৈরি কৃত প্রোবায়োটিক মিশ্রিত করে প্রয়োগ করতে হবে। প্রোবায়োটিক যুক্ত খাদ্য প্রয়োগে চিংড়ীর বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
১১. চিংড়ীর পরিচর্যাঃ প্রতি দুই সপ্তাহ পর চিংড়ীর বৃদ্ধি এবং ঘেরের পানি পরীক্ষা করতে হবে। চিংড়ীর বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে। চিংড়ী চাষের জন্য উপযুক্ত পানির পরিমান নিম্নরুপঃ

আইএমএস পদ্ধতিেেত চিংড়ি চাষ করলে চিংড়ির উৎপাদন সাধারণ চাষের উৎপাদনের চেয়ে বেশি হয়। চিংড়ির রোগবালাই কম হয়। তাই পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধিও জন্য পরিবেশবান্ধব এ পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হলে সূনীল অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক: প্রফেসর, একোয়াকালচার বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ১২০৭.